ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বন্ধু-আড্ডা-অ্যাডাল্ট আলাপ ও সামাজিকতা

হুসাইন আজাদ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
বন্ধু-আড্ডা-অ্যাডাল্ট আলাপ ও সামাজিকতা ছবি: জি এম মুজিবুর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস থেকে নেমে: আসনে বসে থেকেই বারবার কেবল পেছনে তাকাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব রহমত আলী (ছদ্মনাম)। চোখেমুখে ভীষণ বিরক্তি, কিন্তু কিছু বলছেন না।

একই কায়দায় তাকাচ্ছেন তরুণ নুরুল আমিনও (ছদ্মনাম)। তিনিও ভীষণ বিরক্ত।

ঢাকা থেকে সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেসের ‘চ’ বগির ৫৩ ও ৫৪ আসনে স্ত্রীকে নিয়ে বসেছেন রহমত। আর একই বগির ৫৫ নম্বর আসনে নুরুল আমিন।

শুধু এ দু’জনই নয়, তাদের পাশের সিটের প্রায় সবগুলো আসনের যাত্রী পেছনে তাকিয়ে চোখেমুখেই রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এই বিরক্তি-রাগ-ক্ষোভ বগির দরজায় দাঁড়ানো-বসা কিছু সমবয়সী ছেলের উপর, সংখ্যায় ৮ জন, ঢাকার একটি কলেজের শিক্ষার্থী। প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা  ধরে অবিরত হই-হুল্লোড় করছে।

হই-হুল্লোড় নিয়ে বিরক্তি থাকার কথা নয় রহমত আলী বা নুরুল আমিনদের। বন্ধু বলে সেটা আড্ডাবাজি বলে মানা যায়। কিন্তু তাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের বিরক্তি-ক্ষোভ ছেলেগুলোর আড্ডাবাজির নামে অসামাজিক আলাপ এবং নিষিদ্ধ থাকার পরও ট্রেনে ধূমপান!

ছেলেগুলোর প্রথম দিকের আলাপ বিপিএল নিয়ে। এরপর আলাপে আসে বিপিএল না জমার কারণ চিয়ার্স গার্ল নেই বলে। মাঝে আখাউড়া স্টেশনে বিরতি হলে সেখান থেকে সিগারেট নিয়ে ধূমপান করতে করতেই শুরু হয় তাদের সীমালঙ্ঘনের আলাপ। প্রথমে ওপার বাংলার মীরাক্কেল অনুষ্ঠানের অ্যাডাল্ট জোকস, তারপর অ্যাডাল্ট চলচ্চিত্র ‘কসমিক সেক্স’র নায়ককে নিয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট একটি হিজড়া চরিত্রের অশ্লীল সংলাপ। এরপর শুরু হয় ছেলেগুলোর মাদক-নেশা নিয়ে গান। কিছু গানের লাইন এমন, ‘গাঁজার নৌকা পাহাড়তলী যায়… ও মিয়া ভাই, মাঞ্জা মাইরা গাঁঞ্জা খাইতাম চাই…। ’ ‘নেশা আমার পেশারে ভাই নেশা আমার পেশা। ’

এসব গানে গানে এক ছেলে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সী আরেকজনকে সিগারেট খাওয়ার দীক্ষা দিচ্ছিলেন, ‘ওরে যদি আমরা না শিখাই, মিয়া ক্যাডা শিখাইবো, ওর বাপ! হা হা’।

পুরো পথের আলাপে তাদের প্রত্যেকটি বাক্যে গালি-গালাজ। ‘ওই তোর…বাপ!’

আলাপে বোঝা যাচ্ছিল, তারা একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন। এই তরুণরা আড্ডাবাজি করবেন সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু নুরুল আমিনের প্রশ্ন, কোন আলাপ বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় হবে, কোন আলাপ ট্রেনের মতো প্রকাশ্যস্থানে হবে সেই জ্ঞানটুকুও তাদের থাকবে না? এই ট্রেনে অনেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে আছেন, অনেকে তার সন্তান বা মাকে নিয়ে আছেন। কেউ তার বোনকে নিয়েও থাকতে পারেন। এই সামাজিকবোধটুকুও থাকবে না! যদি থাকেওবা, এ ধরনের আলাপকে কি আদৌ কোনো পর্যায়ের বিবেচনা করা যাবে? দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় যেখানে ক্লান্তি ভর করা স্বাভাবিক, সেখানে হুই-হুল্লোড় করে পাশের যাত্রীদের মনোজগতে বিরক্তির অস্থিরতা কোন পর্যায়ের বলে বিবেচনা করা যাবে?

নুরুল আমিন বারবার বোঝাচ্ছিলেন, একজন মুরুব্বি কথা বললে তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া যেতো, কিন্তু কেউই মুখ খুলছেন না। আসলে কেউ মুখ খোলারই সাহস করছেন না। ৮ জন তরুণের আড্ডাবাজিতে বিরক্ত হয়ে যখন নুরুল আমিন পিছু ফিরছিলেন, তখন তারা এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন, যেন কথা বললে উল্টো নুরুল আমিনকেই চুপসে দেবেন। এমন তোপের মুখে পড়ার ভয়েই কিনা ষাটোর্ধ্ব রহমত আলী, এমনকি খানিক পরপর ঘুরে যাওয়া নিরাপত্তাকর্মীরাও কিছু বলছেন না। তার ওপর আবার একজন তো মাঝেমধ্যে বারবার বোঝাচ্ছিলেন, তার বাবা পুলিশের বড় কর্তা।

ক’দিন আগে রাজধানীর একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক’জন শিক্ষার্থী একটি নারী মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে অশালীন ভঙ্গিতে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করায় সেটা নজরে পড়লে অনেকেই কড়া সমালোচনা করেন। ভার্চুয়ালি প্রতিবাদ সহজ বলেই সবাই এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেই উচ্চবাচ্য করেন। কিন্তু কালনী এক্সপ্রেস বোঝালো, সরাসরি বা মুখোমুখি প্রতিবাদ ততোটা সহজ নয়। সেজন্যই কিনা প্রজন্মের পথচ্যুতি ঘটছে। আবার এই পথচ্যুতি প্রতিবাদের পর্যায় পর্যন্তই বা আসবে কেন? পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডিই কি সেটাকে আটকাতে পারে না?

বাংলাদেশ সময়: ১৩১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
এইচএ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।