ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ফের পলিথিনের অবাধ ব্যবহার

সৈয়দ ফারুক হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৬
ফের পলিথিনের অবাধ ব্যবহার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ফের এই ব্যাগের অবাধ ব্যবহার শুরু হয়েছে। এমন এলাকা পাওয়া দুষ্কর, যেখানে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নেই।

প্রকাশ্যে এখন এর ব্যবহার চলছে দেদারছে।

সহজলভ্য ও ব্যবহারে সুবিধা, বিধায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই অভ্যস্ত এটি ব্যবহার করতে। অভিজাত রেস্টুরেন্ট, মুদির দোকান, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে ফুটপাতের প্রায় সব দোকানের পণ্য বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণায় নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রার্থীরা নিজেদের পোস্টারগুলো দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য পলিথিন মুড়িয়ে এলাকার বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। সর্বত্রই নিষিদ্ধ পলিথিনের ছোট-বড় ব্যাগের ছড়াছড়ি।
 
পলিথিনের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকার পরও কেবল রাজধানী ঢাকাতেই দৈনিক ব্যবহৃত হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন। হিসেব মতো, প্রতিমাসে ব্যবহার হচ্ছে ৪২ কোটি পিস পলিথিন। সারাদেশে তা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারি আকারে। যৌথভাবে এ তথ্য জানিয়েছে, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-পবাসহ ১৭টি পরিবেশবাদী সংগঠন। তবে আগের পলিথিন ব্যাগে হাতল ছিল, এখন হাতল ছাড়া পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। আর প্রকাশ্যেই আইন ভঙ্গ করে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে ২০০২ সালে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করে সরকার। ২০০২ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বলা আছে, পলিথিন ব্যাগ বিক্রয়, প্রদর্শন, মজুদ ও বাণিজ্যিকভাবে বিতরণ করা যাবে না। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন ব্যবসায়ী পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও পণ্য পরিবেশনে ব্যবহার করছেন। ওই বছরের ১ জানুয়ারি ঢাকা ও ১ মার্চ সারা দেশে পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত) ২০০২ অনুযায়ী, এ আইন অমান্য করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। আর বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে পলিথিন ব্যবহার করা হলেও এ আইনের কোন প্রয়োগ নেই।

পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, এ আইন বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তাদের অভিযোগ, বাজারে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে নিয়মিত মনিটরিং নেই। এ কারণে অসাধু পলিথিন ব্যাগ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলাশহরে দেদারছে উৎপাদন করছে অপচনশীল এসব ব্যাগ। পলিথিন তৈরির কারখানাগুলোর বেশির ভাগই পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, কামরাঙ্গীচর ও টঙ্গীতে বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। এছাড়া চট্টগ্রামসহ জেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। পলিথিন বাজারজাতকরণে পরিবহন সিন্ডিকেট নামে আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে।

বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দোকানদার হয়ে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি পলিথিন নষ্ট করছে পরিবেশ। নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ না হওয়ার জন্য আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা না থাকা, সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবকে দায়ী করা হচ্ছে।


স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও পরিবেশবাদীদের মতে, পলিথিন অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটিতে সূর্যালোক, পানি ও অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। পচে না বলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায় ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া বিস্তারে বাধা তৈরি করে।

এছাড়া পলিথিন মোড়ানো গরম খাবার খেলে মানুষের ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ হতে পারে। পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকিং করলে তাতে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়, যা দ্রুত পচনে সহায়তা করে। অন্যদিকে, উজ্জ্বল রঙের পলিথিনে রয়েছে সীসা ও ক্যাডমিয়াম, যার সংস্পর্শে শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত ও চর্মপ্রদাহের সৃষ্টি হয়। মাটিকে উত্তপ্ত করা ও গাছের মূল মাটির গভীরে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করে পলিথিন। পুকুরের তলদেশে জমে থাকা পলিথিন মাছ ও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সঙ্কট সৃষ্টি করে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্ম্যা, তুরাগ ও বালু নদীর তলদেশে জমে থাকা কয়েক ফুট পলিথিনের স্তর নদীর তলদেশের পলি আটকে শুধু নদীর নাব্যতাই নষ্ট করছে না, বরং মাছ ও জীববৈচিত্র ধ্বংস করে পানিতে স্বাভাবিক অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস করছে। কৃষি পলিথিন ব্যাগ জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। ঢাকা শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের ৮০ ভাগ ড্রেন পলিথিন ব্যাগ কর্তৃক জমাট বেঁধে আছে। যার দরুন সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরে দেখা দেয় অসহনীয় জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির সময় অনেক ম্যানহোল থেকে শত শত পলিথিন ভেসে বের হতে দেখা যায়। ড্রেনেজ সিস্টেমকে সর্বদাই অচল করে রাখে। সম্প্রতি ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে বর্জ্য অপসারণের যে কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল তাতে দেখা যায়, উত্তোলনকৃত বর্জের অধিকাংশই পলিথিন ব্যাগ। আগে থেকে সর্বনাশা পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হলে নদীর তলদেশ থেকে বর্জ্য উত্তোলনের জন্য ২০৬ কোটি টাকা বাজেট করতে হতো না। বেঁচে যেত সরকারের ২০৬ কোটি টাকা, যা একটি উন্নয়নশীল গরিব দেশের জন্য বিরাট ব্যাপার।

শুধু বুড়িগঙ্গাই নয় বরং ঢাকার চারদিক দিয়ে প্রবাহিত সকল নদীর তলদেশেই পলিথিনের দুষণ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চলছে লাগামহীনভাবে। নদী থেকে শুরু করে শাখা নদী ও ছোট ছোট খাল বিল জলাশয়ের তলদেশেও রয়েছে পলিথিন ব্যাগের মোটা স্তর। নষ্ট হচ্ছে পানির প্রাকৃতিক গুণ। কৃষিক্ষেত্রে পলিথিন ব্যাগ সূর্যের আলোকে ফসলের গোড়ায় পৌঁছ‍ুতে বাধা দেয়। ফলে মাটির ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া মরছে না বলে কৃষিজমিতে উৎপাদন কমে আসছে।

পলিথিন ব্যাগের সহজ প্রাপ্তি এবং সস্তা হওয়ার কারণে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করা যাচ্ছে না। এ কারণে কমে গেছে পাটের ব্যবহার। ফলে চতুর্মুখী সমস্যা তৈরি হয়েছে। ব্যাঙের ছাতার মত বাড়ছে পলিব্যাগ ফ্যাক্টরির সংখ্যা। মানুষকে সচেতন করা এবং কঠোর দিকনির্দেশনার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ৯০ ভাগ মানুষ পাটের ব্যাগ ব্যবহার করছে। অথচ বংলাদেশে নিষিদ্ধ পলিথিন ফিরে আসার কারণে পাটের ব্যবহার কমে গেছে।

এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে বর্তমান সরকার পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে ছয়টি পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটের বস্তা ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। এই অভিযানের ফলে সারা দেশে পাটের বস্তার ব্যবহার বেড়েছে বলে জানা যায়।

পলিথিন বর্জনের প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রাথমিক পর্যায়ে গত বছরের ৩০ নভেম্বর থেকে চাল, ডাল, গম, ভুট্টা, চিনি ও সার এ ছয়টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ওই ছয় পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেয়া না হলে ব্যাংক ঋণ দেয়া হবে না। বাতিল করা হবে এলসি এবং খাদ্য বিভাগের আওতাধীন ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স। এই পলিথিনের স্থলে পাট, কাগজ ও চটের ব্যাগ যা সহজে মাটিতে পচনশীল সেগুলো ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। এগুলো পচলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।

পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে যেসব মালিকদের পলিথিন উৎপাদনের কারখানা রয়েছে তাদেরকে পাটের ব্যাগ তৈরির মেশিন ক্রয়ে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে তারা আগ্রহী হবে। দেশের সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পলিথিন যাতে আসতে না পারে সেটিও নজরদারিতে রাখতে হবে। কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙ্গা সহজলভ্য করার জন্য উদ্যোগ নেয়াসহ মনিটরিং টিম বাড়াতে হবে এবং অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা প্রয়োজন। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সারাদেশে ক্যাম্পেইন, মাইকিং, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করতে হবে। প্রতিটি মহল্লায় ছোট-বড় সব ধরনের দোকানে অভিযান পরিচালনাসহ শপিংমল থেকে ফুটপাতের অস্থায়ী দোকানসহ সর্বত্র যাদের কাছেই পলিথিন পাওয়া যাবে সকলকে জরিমানার আওতায় নিয়ে এলে হয়তো এর ব্যবহার কমবে।

পলিথিন ব্যবহার বন্ধে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং পলিথিন উৎপাদন, বিপণনকারী অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা  ইত্যাদি সহজলভ্য এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল আমদানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই-এর সমন্বয় সাধন করতে হবে।

সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে মার্কেটগুলোতে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত মনিটরিং করা একান্ত প্রয়োজন। সর্বপরি পলিথিন ব্যবহার বন্ধে চাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পরিবেশ। পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। কাজেই পরিবেশ রক্ষায় আমাদেরকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে। সেজন্য প্রথম কাজ হবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।

(উপ-রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।