ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কেমন আছেন প্রবীণেরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
কেমন আছেন প্রবীণেরা বৃদ্ধাশ্রমে স্মৃতিচারণে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিন কাটে প্রবীণদের (ফাইল ফটো)

বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের জীবন যন্ত্রণার কষ্টগাথা প্রচার করছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম।

বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের জীবন যন্ত্রণার কষ্টগাথা প্রচার করছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম।

সঙ্গত কারণেই এমন প্রশ্ন উঠছে যে- প্রবীণেরা কেমন আছেন?

বিপুল সংখ্যক প্রবীণ এখন কেবলমাত্র বেঁচে থাকতেই হাত বাড়িয়ে আছেন নিকটজনের দিকে।

কিন্তু একটু  সহায়তা, কৃতজ্ঞতা ও সহানুভূতি জানানোর সময়-সুযোগও তাদের সন্তানদের হয় না। সংসারে তাদেরকে বোঝা মনে করা হয়। যাদের আয় কম, অভাব নিত্যসঙ্গী, মানবিক সদাচরণের ধারণা নেই, তাদের পরিবারে বৃদ্ধদের অবস্থা আরও করুণ।

ওইসব অবহেলিত হতভাগ্য মানুষের কাছে মৃত্যু কামনাই প্রতিদিনের প্রার্থনা হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-‘মরণরে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। ...মৃত্যু অমৃত করে দান। ...তুঁহু মম তাপ ঘুচাও। মরণ তু আওরে আও’।  

তবুও মানুষ বেঁচে থাকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়।

বাংলাদেশের ষাটোর্ধ বয়স্ক মানুষের অধিকাংশই তার পুত্র-কন্যা বা পুত্রবধূর লাথি-ঝাঁটা খেয়ে আর গাল-মন্দ শুনে বেঁচে থাকেন। খুব অল্পই আশ্রয় পান প্রবীণ নিবাসে। সেখানেও স্মৃতিচারণে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিন কাটে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, নার্গিসের জীবন শুরু হয় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে হাসি-খুশির মধ্যে। বিয়ের পর ব্যবসায়ী স্বামীর ঘরে সুখেই দিন কাটছিল। সময়ের ব্যবধানে  কোলে আসে দুই সন্তান। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার প্রায় অচল হয়ে পড়ে। পরে চাকরি নিয়ে নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন।

সন্তানেরা এখন চাকরি করেন। আর ৬৫ বছর বয়সে নার্গিসের আশ্রয় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।

রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে চায়ে ভিজিয়ে রুটি খাচ্ছিলেন শাহাদত হোসেন। তিনি ঢাকা শহরে রিকশা চালান। চেহারা দেখে সঠিক বয়স বোঝা যায় না। তবে ষাটের বেশিই হবে। কয়েক বছর আগেও রিকশা চালাতে তেমন কষ্ট হতো না। এখন বেশিক্ষণ পারেন না। মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিন চলে খুবই কষ্টে।

সন্তানেরা বিয়ে-শাদি করে আলাদা হয়ে গেছেন, বাবার খোঁজ-খবর নেন না।

এসব বলতে বলতে কাঁধের গামছা দিয়ে চোখ মোছেন শাহাদত।

প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তারা এখন চাকরি থেকে অবসর শেষে এককালীন কোটি টাকা পান। সেই অর্থে সকলেই এক একজন কোটিপতি। এ টাকা দিয়ে তিনি কি কি করবেন- ভেবে পান না। কেউ কেউ ব্যবসা করতে গিয়ে সব হারিয়ে বসেন। আবার অনেকে ব্যাংকক, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যান। অনেকে সস্ত্রীক  হজব্রত পালন করেন। এসবে বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে যায়।

যাদের আগের বাড়তি উপার্জন ছিল বা যারা হিসেবি, তাদের সমস্যা হয় না। বিপাকে পড়েন কিছু নিরীহ মানুষ। বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ মিটিয়ে অনেক সময় ওষুধ কেনার টাকাও থাকে না।                                   

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর ৬ মাস। সে হিসেবে এখন  প্রবীণের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ। ক্রমেই এই সংখ্যা বাড়ছে।

তবে অর্থাভাবে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করতে পারছেন না বৃদ্ধরা। ক্রমবর্ধমান প্রবীণদের জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও তার সুফল মিলছে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন, সমাজ ও পরিবারে মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা, শেষ জীবন আনন্দময় ও কর্মমুখী রাখাসহ প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। তার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা’ প্রণয়ন করে।

নীতিমালায় ৬০ বছর ও তার বেশি বয়সের নাগরিককে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিসভা নীতিমালার অনুমোদন দেয়। ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ওই বছরের ২৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ দেশের এক কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ ব্যক্তিকে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ ঘোষণা করেন।

প্রবীণ নীতিমালা অনুসারে সিনিয়র নাগরিকদের সমাজে বৈষম্যমুক্ত ও নিপীড়নমুক্ত নিরাপদ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইনে আছে- ‘জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্পদ, মর্যাদা, লিঙ্গ নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে’।

কিন্তু আড়াই বছরেও প্রবীণদের কোনো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। এমনকি, প্রতিশ্রুতি অনুসারে পরিচয়পত্রও দিতে পারেনি।

তবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইনের খসড়া করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক প্রবীণ নিবাস বা আবাসন নির্মাণ, চিকিৎসাসেবা প্রদান, জীবন-মানের উন্নয়নে সহায়তা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামসহ  নানা সুযোগ-সুবিধা পাবেন প্রবীণরা।

এছাড়া বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরণের যানবাহনে আসন সংরক্ষণ করতে হবে প্রবীণদের জন্য। পাশাপাশি বিশেষ ছাড়ে টিকিট দেওয়া, আলাদা টিকিট কাউন্টার স্থাপন, তাদের জন্য দিবা সেবাকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। মৃত্যুর পর দাফনের দায়িত্বও পালন করবে রাষ্ট্র। তাদের সম্পদ রক্ষা, সঞ্চয় প্রকল্প গ্রহণ ও বিনোদনমূলক ব্যবস্থা নেবে সরকার।

এতোসব আয়োজন বাস্তবায়িত হলে প্রবীণদের আর বিশেষ কষ্ট থাকবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সেদিন কবে আসবে?

পরিবারের ভেতরেই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হন বয়স্ক মানুষেরা। দেশের কোটি কোটি কৃষক-মজুর পরিবারে  দিন-রাত গাধার মতো খেটে অর্থ উপার্জন করেন পিতা মাতা। সেই অর্থে প্রতিপালিত হয় সন্তান। কিন্তু নিজের  অজ্ঞতা ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থার কারণে সম্পদ রক্ষা ও তার সন্তান প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভের সুযোগ পায় না। হয় না যোগ্য কর্মসংস্থান। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বিয়ের বয়স না হতেই কলেমা পড়ানো হয়। শুরু হয় সংসারে টানাপড়েন।

এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক বসবাস, ভাঙে পরিবার। পরিত্যক্ত বাবা-মা হারিয়ে যান সন্তানের প্রযত্ন থেকে। কবে কোথায় জন্ম হয়েছিল তার, কে তাকে স্তন্যদান করেছিলেন, কে দিয়েছিলেন অন্নের যোগান, সব ভুলে যান তিনি। শুরু হয় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নতুন জীবন-যাপন।

এমনই এক বাস্তবতায় ২০১৩ সালে সরকার ‘মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ আইন’ (ফিডিং অ্যান্ড লজিং টু প্যারেন্টস অ্যাক্ট’২০১৩) পাস করে। এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক সন্তান তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবে। মাতা-পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে কোনও বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারবে না। স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতে হবে, সেবা ও পরিচর্যা করবে’।

৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘মাতার অবর্তমানে নানা-নানি ও পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদিরও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে হবে’।

আইনে ভরণ-পোষণ বলতে খাবার, বস্ত্র, চিকিৎসা, বসবাস ও সঙ্গ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি এ আইন অমান্য করলে প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে। এতে আপস নিষ্পত্তির ধারাও সংযুক্ত আছে। সন্তানের বিরুদ্ধে আনা লিখিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিনমাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
 
আইনটি সম্পর্কে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কে এতো পরিবর্তন এসেছে যে, বৃদ্ধ মা-বাবার নিরাপত্তার বিষয়টি এখন আমাদের ভাবতেই হচ্ছে। এখন প্রয়োজন যেসব পরিবারে বাবা-মা বঞ্চিত হচ্ছেন, তাদের আইনের আওতায় আনা এবং মাসিক আয় থেকে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা’।  

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের আরও কিছু কার্যক্রম রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বয়স্ক ভাতা। যার আওতায় সাড়ে ৩১ লাখ প্রবীণকে মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বয়স বেশি দেখিয়ে ও দলীয় বিবেচনায় নাম তালিকাভুক্তির অভিযোগ আছে। আছে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও। দেশে সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ১৫ হাজার। এর মধ্যে মারা গেছেন প্রায় ৫০ হাজার। জীবিত  সকলের বয়স ষাটের ঊর্ধে। তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা স্বাস্থ্যসেবা। দেশের কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাকেন্দ্র নেই।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রবীণদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. বিল্লাল হোসেন বলেছেন, ‘মানুষ ৭০ বছর বাঁচলেও দূরারোগ্য ব্যাধি ও সংক্রামক রোগের কারণে তার কর্মক্ষমতা বেশি থাকে না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে এমন একটি মেকানিজম আনতে হবে, যেন এই জনগোষ্ঠী সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকেন। তাদের যেনো কারও ওপর নির্ভরশীল হতে না হয়’।

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান বলেছেন, ‘এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা। বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য শুধু সরকারি সাহায্যই সীমিত নয়, বেসরকারিভাবেও এ নিয়ে খুব বেশি কাজ হয় না। তাদের জন্য সামাজিক আন্দোলনে তরুণদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বিষয়টি আনেকেই বুঝতে চান না’।

‘বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হলে ভবিষ্যৎ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য যে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে, তা বেশ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়’।

বেঁচে থাকলে মানুষের জীবনে বার্ধক্য আসবেই। যে মা-বাবা তাদের সন্তানকে পৃথিবীতে এনেছেন, নিজেরা খেয়ে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন, বড় করেছেন, আজ তারা বৃদ্ধ। বয়সের ভারে কর্মক্ষমতাহীন, অসহায়, অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাদের পাশে দাড়ানো একদিকে যেমন সন্তানের অবশ্য কর্তব্য, অন্যদিকে যে মানুষগুলো সারা জীবন শ্রম আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর দিয়ে রাষ্ট্রের সেবা করেছেন, বৃদ্ধ বয়সে তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়াও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।