ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমার বাবা ও একাত্তরের অম্লান স্মৃতিবিজড়িত স্থান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৯
আমার বাবা ও একাত্তরের অম্লান স্মৃতিবিজড়িত স্থান

মা-মাটি-মাতৃভূমি ও বাঙালির আত্মপরিচয় নিহিত বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অমোচনীয় ইতিহাসে। ইতিহাস ও আত্মপরিচয় ছাড়া কোনো জাতি দাঁড়াতে পারেনি। যে জাতির কোনো ইতিহাস নেই, সে জাতির বর্তমান কিংবা আগামী নেই। অতীতই আমাদের প্রেরণা ও শক্তি। ১৯৭১ আমাদের ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত অধ্যায়, যার লাল-কালো অক্ষরের ভেতরে আছে বাঙালির শক্তি ও অস্তিত্ব। 

আমি ১৯৭১ সালের কথা বলবো। শরণার্থী জীবনের কথা বলবো।

শুধু স্মৃতিচারণ নয়, আত্মজীবনের জার্নাল। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার সন্তানদের ডাক দিয়েছিলেন। তার ডাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সাড়া দিয়ে আমাদের টগবগে পূর্বপুরুষরাই দেশ স্বাধীন করেছেন। আমার পিতা ছিলেন তাদের একজন। তাই এ লেখার সর্বাংশে জড়িয়ে আছে আমার বাবার স্বপ্ন ও লড়াই। আত্মজীবনের লড়াইকে লিখতে এসে একজন লেখককে ভূমির ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভুলে উদাসীন গল্প লিখলে চলে না। আমি পূর্বপুরুষের লড়াইয়ের কথা, আমার বাবার কথা বলতে চাই। আমি জানি, দেশের প্রতি দায় ও আত্মঅস্তিত্বের এই জার্নাল কখনোই মূল্যহীন হয়ে যাবে না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসব লেখা অমূল্য হয়ে উঠবে। উত্তরাধিকারীরাই ইতিহাসের ভাষা ও শক্তিকে বহন করেন। আমাদের কৃতি, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে তাদের কাছেই রেখে যেতে হবে। উত্তরাধিকারের পথরেখায় ওরা পথ চলতে থাকুক। আত্মপরিচয়ের শক্তিতে বেঁচে থাকুক।

আমি তো লেখক নই। শব্দের সঙ্গে বসবাস করতে শিখিনি। খাতা-কলম নিয়ে, একটা দায় ও দায়িত্ব নিয়ে লেখার টেবিলে বসে থাকি। ফ্রেমে বাঁধা বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি ও দর্শনকে লিখতে চেষ্টা করি।

নেত্রকোণা জেলার হাওরাঞ্চলে আমার জন্ম। ছোট একটা থানা শহরে কেটেছে আমার শৈশব ও যৌবন। এখানকার মানুষ উকিল মুন্সির গানের মতো সহজ-সরল ও উদার। এখানকার মাটিতে ফলে সোনালি ফসল। এখানকার কংস, ধনু আর জলমগ্ন হাওরে মাছ আর মাছ। এখানকার জমির মতো মানুষের মনটাও উর্বর। খুব অল্পতেই এ অঞ্চলের মানুষ খুশি হয়। এ অঞ্চলের মানুষ বাইরে যেতে চায় না। কেন যাবে? হাওরভর্তি ধান-মাছ রেখে কোন দুঃখে বাইরে যাবে? কুয়াশার শীতল বাতাস, রৌদ্রের হাসিতে এখানকার মাঠ থেকে ভেসে আসে পাকা ধানের সুবাস। এই ধানের সুবাস নাকে নিয়ে কেউ অসুখী হতে পারে না। এমন ভাটি অঞ্চলের মানুষ আমি। আমার বাবা ডাক্তার আখলাকুল হোসেন আহমেদ। একজন মানুষ যখন আরেকজনকে দেখিয়ে বলে, ‘উনি আখলাক ডাক্তারের ছেলে’; আমার বুকটা শান্তিতে ভরে যায়। হাওর ও ভাটি বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে আমার বাবাকে এক নামে সবাই চেনেন। বাবাও চিনতেন সবাইকে। হাওরের মতো বিশাল তার মন। তিনি বেশিরভাগ পরিচিতকে নাম ধরেই ডাকতেন। কারও সঙ্গে দেখা হলে বাড়ির সবার নাম বলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। বাবার ছায়ার পাশে বসতে বসতে মানবিকতা, উদারতা, আন্তরিকতা শিখেছি। বাবা বলতেন, ‘ভাষা শিখতে হবে। ভাষা শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কী বাংলা, কী ইংরেজি; দুটি ভাষাতেই পারদর্শী হতে হবে। নিজেকে প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম ভাষা। ভাষা শিক্ষা ছাড়া জ্ঞানার্জন অসম্ভব। ’ পরীক্ষায় ভালো ফলে তিনি অসম্ভব খুশি হতেন। স্কুলে আমার প্রথম স্থান অর্জনে আনন্দিত হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে প্রথম শ্রেণি পাওয়ার কথা শুনে কতোই না আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন! সবার কাছে আমার ভালো ফলের কথা বলতেন। আমি যখন বৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স করতে অস্ট্রেলিয়া যাই, তিনি যে কতো খুশি হয়েছিলেন, তা আজও মনে পড়ে। আমাদের উপজেলায় কোনো তরুণ কর্মকর্তা এলে তিনি আগ্রহ নিয়ে মিশতেন। আমরা ছোটবেলায় এ রকম অনেক কর্মকর্তার প্রশংসা শুনেছি বাবার মুখে। বাবা বলতেন, ‘এই অফিসার খুব সৎ। ’

আমার বাবার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু বাবাকে প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দেন। ময়মনসিংহ-২২ আসনে নৌকা প্রতীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বাবা ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কাজ করেন। আজ আমি সে স্থানগুলোর কথা লিখবো। আমার বাবার স্মৃতির খোঁজে এসব স্থান আমি ভ্রমণ করে এসেছি।

মেঘালয়ের পথে পথে
৪ থেকে ৭ এপ্রিল (২০১৮) ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে এসেছি। বর্ডারের এবড়োখেবড়ো পথ ধরে কখনো হেঁটেছি, আবার গাড়িতে পথ পাড়ি দিয়েছি আর শিহরিত হয়েছি। এই শিহরণ ও চেতনাকে ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। এই জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে রাঙামাটির পথে ছড়িয়ে আছে ১৯৭১-এর স্মৃতি; আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মেঘালয়ের এই তলদেশেই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ১১নং সেক্টর। মেঘালয়ের এই নির্জন ছায়াতেই আশ্রয় নিয়েছিল লাখ লাখ শরণার্থী। গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। সাউথ গারো হিলের এমনই একটি প্রধান ক্যাম্পের নাম মহেষখলা।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ভাটি বাংলার লোকেরা দলে দলে সীমান্ত এলাকায় হাজির হচ্ছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তখন প্রধান দায়িত্ব ছিল এই অসহায় মানুষদের সহায়তা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জের মানুষ এই মহেষখলা দিয়েই ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করেছিল। ভারতের অভ্যন্তরেও মহেষখলা নামে একটি স্থান ও বাজার রয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় মহেষখলা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়।  

এই মহেষখলা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন বাবা। পরবর্তীকালে তিনি সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের (Civil Administrative Council of Bhali Area of Mymensingh District N.E. Zone No II)  চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। হাজার হাজার মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা, খাবার ও ওষুধ জোগাড় ছিল তার কাজ। মহেষখলা ক্যাম্পে যাওয়ার আগে তিনি ও আব্দুল খালেক (এমপিএ) মিলে পুরো ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করেছেন। এ সময় সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আ. হেকিম চৌধুরীও দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবার মতো আওয়ামী লীগ নেতারা সেদিন ঠিকই বুঝেছিলেন, গেরিলাযুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানি আর্মির মতো একটি শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা পারবো না। তাই এই ভাটি অঞ্চল থেকে কৃষক, ছাত্র-জনতাকে সংগ্রহ করে ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে একটা শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী তৈরিতেই কাজ করেছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি মহাদেও, রংড়া, তুরাসসহ বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবার স্মৃতি ও স্বাক্ষরগুলোকে খুঁজতেই আমার এই মেঘালয় ভ্রমণ। এই ভ্রমণের সঙ্গে আমার স্ত্রী লায়লা আরজুমান এবং আমার ছোট ছেলে সাবাব রয়েছে। আমার বড় ছেলে সাদাবকে নিয়ে আসতে পারলে খুব ভালো হতো। ইতিহাস সম্পর্কে ওর জানার আগ্রহ প্রবল। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেনি।  

শেরপুরের নালিতাবাড়ীর নাকুয়া বর্ডার দিয়ে আমরা ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করি। সীমান্তে প্রবেশের পর সাউথ হিল গারো ডিস্ট্রিক্টের একজন সহকারী কমিশনার, গৌহাটিতে কর্মরত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভ্যর্থনা জানান। তারা আমাদের একটি স্মৃতিসৌধে নিয়ে যান। এটি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের বিএসএফের যে ৯ জন বীরসেনানী এখানে জীবন দান করেছেন, তাদের উদ্দেশে নির্মিত ও তাদের নাম সংবলিত এই স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও নীরবতা পালন করি। কতো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা! এই নয়জন ভারতীয় সৈনিক হয়তো জীবনে কল্পনাও করেননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন দিতে হবে।  

এর পর সাউথ গারো হিলস জেলার ডালু বর্ডার থেকে বাঘমারার উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের মূল যাত্রা মহেষখলা। পাহাড় ও অরণ্যের নির্জন পথ। সন্ধ্যা হওয়ায় বাঘমারা সার্কিট হাউসে থাকতে হলো। সাউথ গারো হিলস জেলার ডেপুটি কমিশনার  এইচ বি মড়ক সার্কিট হাউসে অভ্যর্থনা জানালেন। সঙ্গে জেলার ডিএসপি। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তাদের আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি।  

মহেষখলা ক্যাম্পের খোঁজে
৫ এপ্রিল মহেষখলার উদ্দেশে রওনা হই। পাহাড়ি রাস্তায় অনেক ছায়া। যেখানে গাছপালা নেই, সেখানে রোদ কড়া। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে, দু’পাশে তাকিয়ে আমরা আঁকাবাঁকা পথ, চারপাশের জঙ্গল আর গভীর খাদ দেখছি। দূরে পাহাড়চূড়া কিংবা গাছের সবুজে তুলার মতো জমে আছে মেঘ। মেঘ জমে থাকে বলেই হয়তো এই পাহাড়ের নাম মেঘালয়। মেঘের ধারায় পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কলকল শব্দে সমতলে নেমে আসে ঝরনা। প্রায় ৮২ কিলোমিটার দুর্গম পথ পার হতে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় ৫ ঘণ্টা। কিন্তু মহেষখলায় গিয়ে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।

১৯৭১ সালে আমার বাবা ডা. আখলাকুল হোসাইন এই মহেষখলা ক্যাম্পেরই ইনচার্জ ছিলেন। জিপ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে কী এক আশ্চর্য প্রশান্তি নেমে এলো! মনে হলো, স্বপ্নে আমি এই জায়গায় বহুবার এসেছি। এই মাটির ঘাসে ঘাসে বাবার স্মৃতি। ইশ! যদি বেঁচে থাকতেন। যদি বাবার সঙ্গে এই মহেষখলার মাটিতে দাঁড়াতে পারতাম! আমার স্ত্রী লায়লা আরজুমান আমার আবেগ কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারছিল। সেখানে নেমেই টেলিফোনে আম্মার সঙ্গে কথা বললাম। আম্মাও টেলিফোনে কিছু স্মৃতিচারণ করলেন। তার বয়স এখন ৮০-এর ঊর্ধ্বে।  

হাঁটতে হাঁটতে বয়স্ক লোকদের সঙ্গে কথা বলি। আবেগপ্রবণ হই। বাবার কথা বলি, বাবার কথা জিজ্ঞেস করি। দু-একজন মুরব্বি স্মৃতিচারণও করলেন। ওই সময় বাঁশের বেত দিয়ে তৈরি মাচার ঘরে আমরা থাকতাম। সেই বাড়ি তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু আমি সেই বাড়িটির অবস্থান বের করার চেষ্টা করি। স্মৃতি মেশানো বিবরণ শুনতে শুনতে বয়স্ক লোকেরা একটা জায়গা দেখালেন। আমারও মনে হলো, আমাদের থাকার জন্য যে ঘরটি ছিল, এটি সেই স্থান। আমার মনে আছে, ঝরনায় আমরা গোসল করতাম, সেই ঝরনার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি; যদিও ঝরনায় এখন পানি নেই। বারবার ঝরনার জায়গায় বসে স্মৃতি খুঁজেছি।  

৪৭ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। কিন্তু এলাকাটি এখনও অবহেলিত; তবে ৪৭ বছর আগে তার রূপ কেমন ছিল, তা আজ হয়তো কেউ অনুমান করতে পারবে না। আমার বাবার মতো প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা তখন ক্যাম্পে ক্যাম্পে শক্তি-সাহস ও প্রেরণার মন্ত্র ছড়িয়ে বেড়াতেন। গেরিলা আক্রমণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য কৃষক ও ছাত্রদের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করতেন। তাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে গড়ে তুলতেন- কার যুদ্ধ? কেন যুদ্ধ? কার সঙ্গে যুদ্ধ? এসব প্রশ্ন না জেনে কেউ গেরিলা হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণের ভেতরেই ছিল গেরিলাদের রাজনৈতিক প্রস্তুতির অভিজ্ঞান। বঙ্গবন্ধু সেদিন সবাইকে প্রস্তুত হতে বলেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ আসলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতই ছিল। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কৃষক-যুবাদের যখন ডাক এলো, তখন আর কেউ দ্বিধা করেনি।  

৪৭ বছর আগের একটা বাঁশের বেত দিয়ে তৈরি ঘর আর আমার বাবার স্মৃতির স্বাক্ষরগুলো খুঁজতে খুঁজতে আমি মহেষখলার মাটিতে হাঁটতে থাকি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া আমার শৈশবটা খুঁজতে থাকি। কিছুক্ষণ পর মহাদেও ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হই।

মহাদেও এবং রংড়া ক্যাম্পের খোঁজে
এই মহাদেও থেকে বাবা চিঠি লিখেছিলেন আম্মাকে। রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় একাত্তরের চিঠির যে সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সে সংকলনের ২৭ পৃষ্ঠায় এই চিঠি ছাপা হয়েছে। ১৬ জুন লেখা এই চিঠিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি মহেষখলা থেকে মহাদেও এসেছেন। কিন্তু তার গন্তব্য তুরা। রংড়া হয়ে তুরা যাবেন। সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আব্দুল খালেক এমপিএ ও জোবেদ আলী এমএনএ। চিঠির বিবরণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, পরিবার নিয়ে কতোটা উদ্বিগ্ন তিনি। আম্মাকে সাবধানে থাকতে বলছেন। বাড়িতে থাকলে আক্রমণ হতে পারে- এ রকম আশঙ্কাও করেছেন তিনি। চিঠিটি পড়ে বোঝা যায়, আম্মাকে আরও চিঠি লিখেছেন তিনি। কিন্তু সেসব দুর্লভ চিঠি আমরা হারিয়ে ফেলেছি।  

মহেষখলা ও রংড়ার একটা মধ্যবর্তী স্থান এই মহাদেও। মহাদেও ইয়ুথ ক্যাম্পে যুবকদের ভর্তি করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণে পাঠানো হতো। প্রবীণ লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাম্পটা কোথায় ছিল। তাদের সাহায্যে জায়গাটি খুঁজেও পেলাম। ভাবতে অবাক লাগে, এমন একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধারা দিন-রাত কাটিয়েছিলেন! বারবার জায়গাটি ঘুরেফিরে দেখলাম, ছবি তুললাম। অতঃপর সেখান থেকে রংড়ার উদ্দেশে রওনা হলাম। ১৬ জুন আম্মাকে লেখা চিঠিতে এও লেখা ছিল, ‘তোমরা বাড়ি থেকে সরে গেছো কি-না জানি না। তোমাদের ওপর আক্রমণ আসতে পারে, তাই পূর্ব পত্রে লিখেছিলাম বাড়ি থেকে সরে যেতে। কোথায় আছ তা যেন অন্য লোকে না জানে। ’ আবার লিখেছেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর নিশ্চয়ই শুনেছ যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িও আক্রমণ করতে ছাড়েনি। সুতরাং খুব সাবধান। ’ চিঠির বিবরণ অনুযায়ী মহেষখলা থেকে রংড়ার পুরো ৩৫ কিলোমিটারের পথ বাবা সহযাত্রীদের নিয়ে হেঁটে এসেছিলেন।  

আমরা গাড়িতেই রংড়া এসেছি। সেখানে একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের সহায়তায় রংড়া ক্যাম্পের স্থানগুলো অবলোকন করলাম। খাড়া অসমতল পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে বাঘমারায় সার্কিট হাউসে ফেরার সময় প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে পাহাড়ি এলাকার লাল মাটি। ঘন পাহাড়ের এই সবুজ অরণ্যই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়। পরদিন ওয়েস্ট গারো হিলস জেলার তুরার দিকে রওনা হই। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রয়েছে।  

তুরা ক্যাম্পের খোঁজে
সকালে তুরার পথে বাঘমারা সার্কিট হাউস থেকে বের হলাম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সভায় অংশগ্রহণের জন্য বাবা মহেষখলা থেকে তুরা এসেছিলেন। তাই তুরা দেখতে কেমন, সে আগ্রহ ও আবেগ ছিল। বারবার বাবার কথা মনে হচ্ছিল। বাঘমারা থেকে তুরা প্রায় ১০৪ কি.মি.। কিন্তু রাস্তা খারাপ হওয়ায় সাউথ গারো হিলস জেলার সিকিউরিটিতে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তাদের সহায়তায় ডালু হয়ে গাছুয়াপারা থেকে আম্পাট্টির দিকে রওনা হই (৯০ কি.মি.)। আম্পাট্টিতে অবস্থিত জেলার সার্কিট হাউসে তুরা যাওয়ার পথে বিশ্রাম নেই। সেখানে সাউথ ওয়েস্ট গারো হিলস জেলার ডেপুটি কমিশনার সিরিল ভি. দারলং দিয়েংদোহ আমাদের স্বাগত জানান। ওয়েস্ট গারো হিলসের জেলা শহর তুরায় পৌঁছার পর সার্কিট হাউসে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। সার্কিট হাউসের প্রবেশদ্বারে তাদের স্থানীয় সংস্কৃতিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উত্তরীয়, মাথায় টুপি এবং কটি পরিধান করিয়ে বরণ করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিআইজি সাহেব সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসেন।  

বাবা এই তুরায় মূলত বিভিন্ন মিটিংয়ে আসতেন। তুরা ছিল মূলত প্রশিক্ষণ শিবির। মহেষখলা, মহাদেও, রংড়া, বাঘমারা, শিববাড়ী ক্যাম্পে যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হতো, তাদেরকে প্রশিক্ষণের জন্য তুরায় প্রেরণ করা হতো। তুরায় ঘুরে সর্বক্ষণ বাবার স্মৃতি মনে ভাসছিল।  

আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিবিজড়িত এলাকা ছিল মহেষখলা, মহাদেও, রংড়া ও তুরা। আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এপ্রিল মাসেই তিনি এ কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। চিকিৎসাসেবা দিয়ে, শরণার্থীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে সহায়তা প্রদান করে, মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তিনি নিবেদিতভাবে এই গারো হিল অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৪৭ বছর পর আমি সেই স্থানগুলোতে আমার ছোট ছেলে সাবাবকেও নিয়ে এসেছি। ও জানুক ওর পূর্বপুরুষের কৃতি। আমার বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, একসঙ্গে নিয়ে স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দেখাতে পারতাম। তার জীবদ্দশায় মুক্তিযুদ্ধের অজানা কাহিনী আরও যদি জেনে নিতে পারতাম, সে কথাই আজ ভীষণভাবে মনে পড়ছে! বাবার পদস্পর্শিত স্থানে গিয়ে উপলব্ধি করেছি পিতৃস্নেহের প্রবলতা। তার চিঠি, তার নেতৃত্ব ও সংগ্রাম, পরিবারের প্রতি ভালোবাসা আর দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ আমাকে, আমার উত্তর-প্রজন্মকে আরও বেশি উজ্জীবিত করে তুলবে।  

আমি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রতি, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার বাবার স্মৃতিময় জায়গাগুলো পরিবারসহ ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছেন। তার এই সহৃদয় সহায়তা আমাকে শিকড়ের সন্ধানে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জায়গাগুলো ঘুরতে গিয়ে ভারত সরকারের যে সহযোগিতা পেয়েছি, সে জন্য আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। এ ভ্রমণ স্মৃতিতে চিরঅম্লান হয়ে থাকবে।

লেখক: সাজ্জাদুল হাসান; সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।