ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিএনপি যেন পথহারা খোঁড়া ঘোড়া

পীর হাবিবুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০২০
বিএনপি যেন পথহারা খোঁড়া ঘোড়া পীর হাবিবুর রহমান, ফাইল ফটো

বার্ধক্যপীড়িত দিগ্ভ্রান্ত মুমূর্ষু এক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে বিএনপি। নেতারা জানেন না কী হচ্ছে কী করবেন।

কর্মীরা জানেন না তাদের কী করতে হবে। নেতারা কী বার্তা দেবেন? সব ঝিমিয়ে গেছে। ক্ষমতার বাইরে ১৪ বছর থাকায় অনেকে দলও ছাড়ছেন। মাঝেমধ্যে কোথাও সভা হলেই নেতায় নেতায় হাতাহাতি। নিয়মিত পল্টনের অসহ্য বয়ান। মাঠে নেই, ময়দানে নেই, সাংগঠনিক সফরে নেই, জেলায় জেলায় সমাবেশ নেই। কর্মীসভা নেই। দল গোছানোর আলামত নেই। নেতৃত্বহীন বিএনপি কী চায় কেউ জানে না। কৌশল কী কর্মীরাও জানেন না। সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়াকে নেতা মানলেও তারেকে নারাজ। এটা বলারও সাহস নেই। তাই যে বার্তাই আসে কবুল করেন। এককালের জনপ্রিয় দাপুটে চমক সৃষ্টি করা টগবগে তারুণ্যের শাসক দল বিএনপি একদম খোঁড়া ঘোড়া। ’৭৫-উত্তর আওয়ামী লীগ চরম দুঃসময়েও দলকে গুছিয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। নির্বাসনে। তবে কি বিএনপি ক্ষমতার দল বিরোধী দলে অযোগ্য? কিন্তু সেনাশাসন-বিরোধী সংগ্রামে ছাত্রদলের শক্তিতেই খালেদা জিয়া তো নেতৃত্বেই উঠে আসেননি ক্ষমতায়ও এসেছিলেন। ছাত্রদল এখন শিক্ষাঙ্গনে মুছে যাওয়া নাম।

তাহলে বিএনপির এ করুণ দশা কেন! আইসিইউতে দল চলে গেছে। সমালোচনা নিতে পারে না। গালিগালাজ করে। আত্মসমালোচনাও করে না। বিগত নির্বাচনের পর কি একটি অর্থবহ বর্ধিত সভা করেছে। চুলচেরা বিশ্লেষণ! কেন লালগালিচা সংবর্ধনা নিয়ে এসে ঢাকায় প্রণব মুখার্জির বৈঠক বাতিল করলেন খালেদা জিয়া? নেতারা ভারতের নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে খালি হাতে ফিরলেন। কেন ২০১৪ সালের যৌবনে মিত্রশক্তি পাশে রেখেও বর্জনের হঠকারিতা। কেন যাননি শেখ হাসিনার নৈশভোজ বৈঠকে? উল্টো ব্যর্থ হয়ে জ্বালাও-পোড়াও নীতি, খালেদার জেল, অসুস্থতা, তারেক রহমানের দণ্ড, নির্বাসন তবু কেন বিদেশ থেকে সিদ্ধান্ত? জামায়াত ছেড়ে দেয়নি কেন? নির্বাচনে কেন মনোনয়ন-বাণিজ্য? এ কেমন রুগ্ন গণবিচ্ছিন্ন কর্মীবিচ্ছিন্ন বিএনপি যার লক্ষ্য নেই। পথের ঠিকানা নেই। জনপ্রিয়তা অর্জন করে উদ্দেশ্য পূরণের আলামত নেই।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, খালেদা জিয়া কীসের আপসহীন। আপস না করলে উনি জেল থেকে বেরোলেন ক্যামনে। সরকারের কথা শুনেই তো বেরিয়ে এসেছেন। তিনি খালেদা জিয়ার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, বেগম জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন তার একটাই কারণ, তিনি জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী। অথচ সেই জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার করলেন না কেন? শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কিছুদিন আগে বলেছিলেন, জীবনে আর কোনো দিন মিথ্যা কথা বলবেন না। কারণ মিথ্যা বলে লাভ কী?

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা নেতাকর্মীরা সরকারের সঙ্গে আপস করে ফেলেছি। এ কারণে বেগম জিয়া জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু জনমনে তাঁর যে স্থায়ী আসন তার কোনো রিপ্লেসমেন্ট নেই। খালেদা জিয়াই বিএনপির বর্তমান ও ভবিষ্যতের একমাত্র নেতা। তাঁর পরে কে জানি না।

ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর বলেন, তারেক রহমান দল কতটুকু চালাতে পারবেন আপনারাও দেখেন আমিও দেখি। লন্ডনে বসে কথাবার্তা-ভাব আদান-প্রদান করা কঠিন। তিনি খোমেনি নন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথেই আছেন। তাঁর এখন দলের চিফ অ্যাডভাইজার হওয়া উচিত। তিনি জেল থেকে কীভাবে মুক্তি পেলেন জানি না। তাঁর উচিত ছিল জেলে ফেরত যাওয়া। তাঁকে এক জেলখানা থেকে বের করে বাসার জেলখানায় ঢোকানো হয়েছে। দেশবাসীর বিরাট ভালোবাসা আছে তাঁর জন্য। তিনি বলেন, তারেক রহমানকে বেগম খালেদা জিয়ার উত্তরসূরি করা ভুল সিদ্ধান্ত। সে অটোমেটিক উত্তরসূরি হতো। তারেককে আমি স্নেহ করি, কিন্তু দূর থেকে যোগ্যতা প্রমাণ করা যায় না। কেউ একটি শব্দও ভুল বলেননি। দলের প্রতিষ্ঠাতা বি. চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, সাইফুর রহমানদের মানসিক যন্ত্রণা বা দলছাড়া করার পরিণতি কি শুভ হয়েছে? বিএনপি কি শাসনামলে দলীয় ভুল বা পাকিস্তানি আইএসআইয়ের খপ্পরে পতিত হয়ে রাজনীতির সর্বনাশ করেনি? সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ বা কৌশল নির্ধারণ করেছে?

সবখানে একটা কথা প্রচলিত- বিএনপিজুড়ে এমনকি খালেদা জিয়ার পাশেও সরকারের এজেন্ট। বিএনপি নেতারাও নিজেদের মধ্যে কথা বলতে সংকোচবোধ করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেন। এক কথায়, সরকারের সঙ্গে আপস করে দিন কাটায় বিএনপি। এভাবে চললে একটি শক্তিশালী জনপ্রিয় দল কি তবে নেতৃত্বের অভাবে আর ভ্রান্তনীতিতে ভাসানী ন্যাপ বা মুসলিম লীগের পরিণতি বহন করবে? এ দুইয়ের সঙ্গে মডারেটদের নিয়েই সেনাশাসক জিয়া বিএনপির জন্ম দিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে। ’৮৬-এর নির্বাচনে এরশাদ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের জিততে দিলে, বিগত দুটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি নাটক না করলে বিএনপির পরিণতি তা হতো না সে কথা বলা যায় না।

এটা সত্য, বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন দলের জনপ্রিয় প্রাণশক্তি। সেখানে তিনি আজ আপসহীন থেকে আপস করা অসহায় অসুস্থ কারাবন্দি। শেখ হাসিনার কৃপায় জেলমুক্ত হয়ে নিজ বাসায় বন্দীর জীবন। রাজনীতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই।

ক্যান্টনমেন্টের বাড়িছাড়া থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার রাজনীতির পতন শুরু হয়। এখন করুণ পরিণতি দেখছেন বন্দিশালায়। এ অবস্থায় লন্ডন নির্বাসিত দলের দণ্ডিত বিতর্কিত নেতা তারেক রহমান বিএনপিকে জাগিয়ে তুলবেন সে আশা কেউ করছেন না। দলে সম্মেলন নেই, হচ্ছে কমিটি-বাণিজ্য। রাজনীতিতে যেন বিএনপি অবুঝ বালক। বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্ক কারা কেউ জানে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির কর্তৃত্ব বলে কিছু নেই। সমাজে প্রভাব থাকলেও দলে অলঙ্কার মাত্র। কর্তৃত্বহীন নেতারা জানেন না খালেদা জিয়ার মুক্তি কীভাবে হলো। পরিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এটুকু আদায় করেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে জোট করে ভোট করলেও পেছন দরজায় জামায়াতকে সঙ্গী করে ৪০টি আসন লাভের সুযোগও হাতছাড়া করেছে। জামায়াত প্রশ্নে দেশে একা, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিএনপি মিত্রহীন। একসময় যাদের প্রতি আশা রাখত গায়েবি কিছু ঘটিয়ে দেবেন আর বিএনপি সেখানে জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতায় ফিরবে সে আশার আলো নিভে গেছে। তাইওয়ান প্রশ্নে চীনকে হারিয়েছিল অনেক আগেই। সেই চীন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হয়েও উন্নয়নের কূটনীতিতে এখন শেখ হাসিনার আঁচলেই বাঁধা পড়েছে। একাত্তরের জন্মের বন্ধু ভারতের জনগণও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে দুই দেশের যে বন্ধুত্ব উচ্চতায় ছিল ’৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের পর সংবিধান পরিবর্তন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আগমনের সঙ্গে একাত্তরের পরাজয়ের লজ্জা গ্লানি অপমানের প্রতিশোধে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রতিশোধের কালো হাত আরও প্রসারিত করে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে একাত্তরের বন্ধু ভারতের বিরুদ্ধে নানামুখী অশুভ তৎপরতা চালায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে হাতটা গুটিয়ে নিতে হয়। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে সক্রিয় করে তোলে। আওয়ামী লীগ দমন করে আর বিএনপি-জামায়াত প্রশ্রয় দেয়। বিষয়টি আদর্শিক। সেই আদর্শের ভিত্তি একাত্তরের পরাজিত সাম্প্রদায়িকতা বনাম বিজয়ী ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক শক্তির লড়াই। বিএনপি যতই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবি করুক কার্যত বিরোধী শক্তির পেটে ঢুকে নেতিবাচক কার্যক্রমও শুরু করে। পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের হাতের পুতুল হয়ে ভারতের সমর্থন আশা করে কীভাবে?

বিএনপি-জামায়াতের আমলে এ দেশে জাল বিস্তার করেছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বাংলাদেশকে ঘাঁটি করে ভারতের জঙ্গি সংগঠন সংযুক্ত মুক্তিবাহিনী, উলফার বিস্তার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল অবধি বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলাকে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় ভারতে নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল উলফাকে। আইএসআইয়ের মদদে ভারতে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য সবরকম সহায়তা দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। অস্ত্র চোরাকারবারের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের নাশকতামূলক কাজের সুযোগ করে দিয়েছিল চারদলীয় জোট সরকার। সেটাই ধরা পড়ছে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলায়।

চট্টগ্রাম অস্ত্র উদ্ধার মামলায় প্রমাণিত হয় বিএনপি-জামায়াত সরকার উলফাকে বাংলাদেশের জমি ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিল। এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম এবং এনএসআইয়ের সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাবুদ্দিন ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এ কথা স্বীকারও করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ভারতীয় জঙ্গিদের অস্ত্র পাচারে বাংলাদেশিরাও আইএসআইকে সাহায্য করেছে। উলফার স্বঘোষিত কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া তখন বাংলাদেশেই ছিলেন। চীন থেকে এ বিশাল পরিমাণ অস্ত্র আনার বিষয়টি তিনি সরাসরি তদারকি করছিলেন।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বাংলাদেশের মাটিতে ভালোমতো প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল আইএসআই। ভারতবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষের বাতাস ছড়িয়েছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার গঠিত হলে লাগাম টানা হয়। তার আগে ১৯৯১-১৯৯৬ ছিল আইএসআইয়ের মুক্ত বিচরণভূমি বাংলাদেশে। ২০০১-২০০৬ শাসনামলে তারা দানবশক্তি হয়ে প্রশ্রয় পেয়েছিল।

বিএনপি-জামায়াত আমলে আইএসআইয়ের মেহমানরা বাংলাদেশে জামাই আদরেই ছিল। সরকারি আতিথেয়তায় অস্ত্র চোরাকারবার বা অস্ত্র প্রশিক্ষণেরও বন্দোবস্ত হয়। এমনকি বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করারও সুযোগ করে দেওয়া হয় তাদের। উলফার পরিচালনায় বাংলাদেশে শুরু হয়, ‘ঊষা ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা’, ‘অনির্বাণ গার্মেন্ট লিমিটেড, চট্টগ্রাম’, ‘করাচি গার্মেন্ট, চট্টগ্রাম’ প্রভৃতি। সরকারের সমর্থন বা সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কোনোমতেই গড়ে তোলা সম্ভব হতো না উলফার পক্ষে। ২০০৬ সালে আমেরিকার বিখ্যাত সংস্থা স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট বা স্টার্টফোরের গবেষণায় উঠে আসে উলফাপ্রধান পরেশ বড়ুয়ার বিশাল ধনসম্পদের খতিয়ান।

উলফার ভারতবিরোধী কাজে আইএসআইয়ের প্রশংসার হাজারো উদাহরণ রয়েছে। ২০০২ সালে পাকিস্তানের ফৌজি প্রশাসক জেনারেল মোশাররফের বাংলাদেশ সফরের আগে ৩০ জুলাই পাকিস্তানের সরকারি টিভি চ্যানেলেই তো উলফার গুণকীর্তন করা হয়। অনুষ্ঠানের নামই ছিল, ‘ব্রেভারি অ্যান্ড গ্লোরি অব উলফা’। অর্থাৎ, উলফার সাহসিকতা ও গৌরব প্রচারে ব্যস্ত ছিল পাকিস্তান। সেখানে প্রশংসিত হয় উলফার নাশকতামূলক কাজকর্ম।

জেনারেল মোশাররফের ঢাকায় অবস্থানকালে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করানো হয় উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়ার। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে এজন্য নিয়ে যাওয়া হয় শেরাটন হোটেলে। সেখানেই উলফা নেতার সঙ্গে কথা বলেন মোশাররফ। ২০১০-এর ৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ অভিযোগ করেন। কিন্তু তার এ মন্তব্যের পর পাকিস্তান সরকারিভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বিএনপি-জামায়াতের আমলে পাকিস্তান আসলে প্রকাশ্যেই ভারতবিরোধী শক্তিকে মদদ দিয়েছে। ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের জমি। বিএনপি কি সেই পাপমুক্তি ঘটিয়েছে? সরকারবিরোধী বা ভারতবিরোধী অসন্তোষ শক্তি নয়, শক্তি হলো রাজনীতির আদর্শ। সেটা কি বিএনপি পরিবর্তন করেছে?

’৭১-এর যুদ্ধের পরাজয় আসলে ভুলতে পারছে না পাকিস্তান। তাই বাংলাদেশি দোসরদের সঙ্গে নিয়ে সেই হারের প্রতিশোধ নিতে চায় তারা। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও তাদের শত্রু। কিন্তু মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে। আইএসআই এখন আর বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের মাটি সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করেছেন। সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়া বন্ধ করে গোটা দুনিয়ার কাছেই শান্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন হাসিনা। অথচ বিএনপি-জামায়াতের আমলে পাকিস্তানের মদদে সন্ত্রাসীদেরই মদদ দিয়েছে খালেদার সরকার। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় প্রমাণিত আইএসআইয়ের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপি সরকারের অশুভ আঁতাতের বিষয়টি।

১০ ট্রাকের ঘটনা একটি মাত্র। ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার বিভীষিকা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের আলো নিভিয়ে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। দেশজুড়ে রাজনৈতিক হত্যা, গ্রেনেড বোমা সন্ত্রাসে কাঁপিয়ে দেওয়ার নেপথ্যেই ছিল আইএসআই ও বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের রাষ্ট্রযন্ত্রের যৌথ প্রয়াস। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মদদ সৃষ্টি ভয়াবহ ছিল। শেখ হাসিনা সব গুঁড়িয়ে দিলেও বিএনপি তার অপশাসনের ভুলগুলো চিহ্নিত করে নিজেদের শোধরানোর পথ খোঁজেনি। হেফাজত নিয়ে শাপলা চত্বরের খেলোয়াড়রা আরেক দফা হঠকারী করে সর্বনাশ করেন। বামপাড়া থেকে আসা সেই ঝুঁটি বাঁধা নুরুল ইসলাম ছোটন এখন কোথায়? যিনি হেফাজতের প্রলয়ের নেপথ্য নায়ক ছিলেন। বিএনপি জমানায় হাওয়া ভবনের লোক। বিএনপির শুভচিন্তার সিনিয়র তরুণ নেতৃত্ব কোথায় কাজে লাগছে। মনোনয়ন কমিটি বাণিজ্য হলে রাজনীতি না থাকলে কীভাবে হবে? পাকিস্তান এমন এক অভিশপ্ত দেশ যা পৃথিবীতে সামরিকতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্ব হত্যাসহ সব মিলিয়ে পশ্চাদপদ এক দারিদ্র্যপীড়িত সন্ত্রাসকবলিত জনপদ। অথচ নিজ দেশের ভাগ্যোন্নয়নের চেয়ে তারা নিজের সীমাহীন ব্যর্থতার পাহাড়ে বসে এক বেলা খেতে না পারলেও একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধে মরিয়া। তাই আওয়ামী লীগ সরলেই সন্ত্রাসবাদের হাত বাড়ায় এ দেশে, ভারতকে অশান্ত রাখতে। ভারতের জন্য বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকার যেমন নিরাপদ, তেমনি আওয়ামী লীগের জন্যও ভারত আদর্শিক বন্ধু। ভারতবিদ্বেষ বাতাস এখনো ছড়ানো হচ্ছে। বন্ধুর সঙ্গে সমস্যা বাকি থাকলেও বসে মিটমাট করা যায়। ঢাকায় নবনিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী সেদিন এক নৈশভোজ আড্ডায় মিলিত হলেন। কথায় জাদু আছে বাংলাদেশি জামাইয়ের। জাঁদরেল কূটনীতিক দক্ষ ও পরিশ্রমী মনে হলো। সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ দুই দেশের উন্নয়নে সম্পর্ক উষ্ণ রাখতে ভূমিকা রাখতে পারবেন।

কিন্তু চিরশত্রু পাকিস্তানের একাত্তরের বর্বরতার গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের দগদগে ঘায়ের যন্ত্রণা কখনো উপশমের সুযোগ নেই।

বিগত নির্বাচনেও বিএনপি জামায়াতকে ছাড়েনি। পশ্চিমারাও পছন্দ করেনি। ’৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর পর শেখ হাসিনাকে দলের নেতৃত্বে আনে। তার আগে নেতারাই দলকে কঠিন চাপে সংগঠিত করেছেন। এখন দেশের ভিতরে থাকা নেতৃত্ব থেকে চেয়ারম্যান-মহাসচিবসহ তরুণ শক্তিনির্ভর বিএনপি না গড়লে দলটি আগামী নির্বাচনে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবে না। শেখ হাসিনা এখনই আগামী নির্বাচনের পরিকল্পনা শুরু করেছেন। আর বিএনপি এখনো মুমূর্ষু রোগীর মতো আইসিইউতে শুয়ে আছে। অথচ গণতন্ত্রের জন্য একটি শক্তিশালী কার্যকর বিরোধী দল অনিবার্য। বিএনপি সেটি হতে পারবে? গায়েবি নেতৃত্বের গায়েবি আদেশ নয়, জামায়াত ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পরিষ্কার অবস্থান নিয়ে যোগ্য নেতৃত্বনির্ভর দলকে সাজিয়ে গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে পারবে চমক দেখাতে? শেখ হাসিনার মাথায় অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের মুকুট দেখে জনগণ, বিএনপির মাথায় কী দেখে বলতে পারবেন নেতারা?

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০২০
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।