ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

উন্নয়ন-অর্জনের সঙ্গে রাজনৈতিক চাপেও ছিল আ.লীগ

শামীম খান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২২
উন্নয়ন-অর্জনের সঙ্গে রাজনৈতিক চাপেও ছিল আ.লীগ

ঢাকা: সরকারের উন্নয়ন সফলতার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য এবং রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলার মধ্য দিয়ে ২০২২ সাল পার করলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠে সরকারের উন্নয়ন সফলতায় বেশ কয়েকটি পালক যুক্ত হয়েছে বিদায়ী বছরটিতে।

তবে বছরটিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হয়েছে সরকারকে, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্যেও নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনুষ্ঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন।

আওয়ামী লীগের সম্মেলন
গত ২৪ ডিসেস্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বড় কোনো পরিবর্তন ছাড়াই দলের নতুন কার্যনির্বাহী সংসদের অধিকাংশ পদ ঘোষণা করেছে দলটি। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশম বারের মতো দলটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আর টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী পক্ষের আন্দোলন এবং নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে তেমন কোনো পরিবর্তন আনেননি দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। পুরনোদের প্রাধান্য দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেছেন তিনি।

১০ ডিসেম্বরের রাজনৈতিক উত্তাপ
বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় ছিল ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনা। দিনটিকে কেন্দ্র করে রাজপথের রাজনীতিও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠ মোটামুটি শান্ত থাকলেও ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে থাকে। গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি ঘিরে আগে থেকেই একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দেয়। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে একটা টানটান উত্তেজনা তৈরি হয়।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলা সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আগে থেকই মাঠে থাকার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হলেও নয়াপল্টনে রাস্তার ওপর সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় দলটি। এই কর্মসূচি থেকে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র ছিল বলে ক্ষমতাসীনরা অভিযোগ করেন। বিএনপিকে রাজনেতিকভাবে মোকাবিলা করতে আগে থেকেই মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। এ পরিস্থিতিতে সরকার কঠোর অবস্থান নিলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি রাজধানীর গোলাপবাগে সমাবেশ করতে বাধ্য হয়। এটাকে বিএনপির রাজনৈতিক পরাজয় বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়। এ দিন থেকে বিএনপিকে মোকাবিলা করতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

সবচেয়ে বড় সাফল্য পদ্মা সেতু 
বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয় বছরটিতে। গত ২৫ জনু উৎসবমুখর পরিবেশে সেতুটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের সর্ববৃহৎ এই সেতু নির্মাণ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করার আগে থেকেই এই প্রকল্প নিয়ে শুরু হয় আন্তর্জাতিক জটিলতা। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এসে উপস্থিত হয়। এই পরিস্থিতিতে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই চ্যালেঞ্জিং কাজ শেষ করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে যানচলাচল শুরু হয় ২০২২ সালে। এটাই আওয়ামী লীগ সরকারের এই মেয়াদসহ চলতি টানা তিন মেয়াদের সরকারের বিশাল রাজনৈতিক অর্জন, যেটা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সুবিধা এনে দেবে।

নতুন মাইলফলক মেট্রোরেল
আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি বড় অর্জন রাজধানীতে মেট্রোরেল নির্মাণ। মেট্রোরেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত দিক থেকে নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে। এই মেট্রোরেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈদ্যুতিক ট্রেন এবং দ্রুত গতিসম্পন্ন ট্রেনের যুগে প্রবেশ করেছে, যার সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। গত ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় মেট্রোরেল আরেকটি পালক যুক্ত করলো। এটা আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের নির্বাচনী সফলতা এনে দেবে বলে দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।

অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পের উদ্বোধন
বছরটিতে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজের বড় অগ্রগতি ও উদ্বোধন হয়েছে। গত ১৮ অক্টোবর দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের রিঅ্যাক্টর স্থাপন করা হয়। এটি দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এ যাবতকালে দেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প। রিঅ্যাক্টর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল যন্ত্রাংশ। এটি স্থাপন এ প্রকল্পের মাইলফলক অগ্রগতি। এর আগের বছর প্রথম ইউনিটের রিঅ্যাক্টর স্থাপন করা হয়। ২০২২ সালেই একদিনে একশ সেতু এবং একশ সড়কের উদ্বোধন হয়েছে। উদ্বোধন করা হয়েছে কর্ণফুলি নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রথম টিউবের। সরকারের এসব উন্নয়ন অগ্রগতি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অর্জনের সঙ্গে যুক্ত হবে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য এই অর্জনগুলি বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তারা।

‘খেলা হবে’ স্লোগান
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘খেলা হবে’ স্লোগান দেশের রাজনীতির মাঠে একটি আলোচিত বিষয় ছিল। ওবায়দুল কাদের স্লোগানটি রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসেন। এ বছরের শেষদিকে অর্থাৎ অক্টোবর মাস থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে নামে। বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগও মাঠে নামে। এই সব কর্মসূচিতে ‘খেলা হবে’ স্লোগানটিও মাঠে নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিএনপির শাসন আমলের দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে সভা-সমাবেশের বক্তৃতায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন—খেলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, লুটপাটের বিরুদ্ধে, অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং নির্বাচনে। স্লোগানটি দ্রুতই বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে। তবে স্লোগানটি নিয়ে সমালোচনাও আসে। রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ ‘খেলা হবে’ স্লোগান রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মন্তব্য করেন। জাতীয় সংসদেও এটি নিয়ে আপত্তি করে বক্তব্য আসে। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রবীণ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ আপত্তি তোলেন। সংসদের বাইরে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদও রাজনীতিতে এ ধরনের স্লোগান দেওয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২২
এসকে/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।