ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

বছরজুড়ে ক‍ূটনৈতিক চাপেও অবিচল সরকার

জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩
বছরজুড়ে ক‍ূটনৈতিক চাপেও অবিচল সরকার

ঢাকা: বছর শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদলের মত ঘটনা ঘটলেও পুরো বছর কূটনৈতিক মহলের নানামুখি চাপের মোকাবেলা করতে হয়েছে সরকারকে। বিশ্বব্যাপী ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে নানা অপপ্রচারের।

সম্মুখীন হতে হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বন্ধুরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের। তবে সরকার সকল চাপ সামলেছে কূটনৈতিক তরিকায়।

বিরোধী দলের দফায় দফায় ডাকা হরতাল-অবরোধ, আর সেসব হরতালে জনজীবন সহিংসতার মুখে পড়ায় দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে হেফাজতের সমাবেশ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে।

এছাড়া সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়েও শুরু থেকেই সরকারকে চাপে রেখেছে আন্তর্জাতিক মহল। দু’দলের মধ্যে সংলাপের জন্য আসে জাতিসংঘের বিশেষ দূতও।

এমন পরিস্থিতিতে বারবার বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেছে সরকার। জানিয়েছে নানা উদ্যোগের কথা। একই সঙ্গে বিরোধী পক্ষের অসহযোগিতা আর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বর্ণনাও জানানো হয়েছে বিদেশি বন্ধুদের।

এত কিছুর মধ্যেও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। বহুল আলোচিত টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। ভারতের লোকসভার অধিবেশনে উঠেছে স্থল সীমান্তচুক্তি । পাকিস্তান যখন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছে ছাড় দেওয়া হয়নি বাংলোদেশের পক্ষ থেকেও। এভাবেই কেটেছে বছরটি। বছরজুড়ে বেশকিছু কূটনৈতিক বিষয়গুলো আলোচনায় ছিল:

জাতিসংঘের দুতিয়ালি: নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংকট সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের দুতিয়ালিতে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সংলাপের সুযোগ তৈরি হয়। দেশের প্রধান দুই নেত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে, এমনকি টেলিফোন করে জাতিসংঘ মহাসচিব সঙ্কট সমাধানে সংলাপের আহ্বান জানান।

তবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা এবং বিরোধী দলের টানা অবরোধে দু’দলের মধ্যে দূরত্ব আরো বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেস তারানকো মধ্যস্থতার শেষ উদ্যোগ হিসেবে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ সফর করেন। এ সফরে বেশ কাঠ-খড় পুড়িয়ে তিনি দুদলের মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠক করাতে সক্ষম হন। কিন্তু রাজনীতিকদের সদিচ্ছার অভাবে সে সংলাপ ব্যর্থ হয়।

যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গে নানা চাপ: যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গে শুরু থেকেই বিদেশিদের চাপে পড়ে সরকার। নানা অজুহাতে এ বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে প্রভাবশালী দেশগুলো চাপ দিতে থাকে। সরকারের শেষ বছরে এ চাপ আরো প্রবল হয়। বিশেষ করে যখন কাদের মোল্লার মামলার রায় কার্যকর করার সময় আসে তখন সরাসরি এ মৃ্ত্যুদণ্ড বন্ধের দাবিতে বিবৃতি দেয় জাতিসংঘ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তো প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে মৃত্যুদণ্ড ঠেকানোর অনুরোধ করেন। একই সুরে সুর মিলিয়ে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করতে অনুরোধ জানায়। বিশেষ করে তুরস্ক শুরু থেকেই এ বিচারের বিপক্ষে মত দিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এমনকি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে বারবার তা বন্ধের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে সরকার বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছে। কার্যকর করেছে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড।

পাকিস্তানের ‘নাক গলানো’ এবং কড়া জবাব: বিজয়ের মাসে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। এ ঘটনায় পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবসের দিনে এ শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি বাংলাদেশ। পরদিনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয় ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনারকে। দেওয়া হয় কড়া প্রতিবাদ। জানানো হয় কাদের মোল্লার ফাঁসি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ বিষয়ে পাকিস্তান নাক গলিয়ে ভাল করে ‍নি।

কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহবান গণজাগরণ মঞ্চের: কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগ মোড়ে গড়ে ওঠা গণজাগরণমঞ্চ পাকিস্তানের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। প্রতিবাদে ফেটে পড়া শাহবাগ ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করে। পরে পুলিশের বাধার মুখে তারা সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। সেখানে থেমে না গিয়ে গণজাগরণমঞ্চ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেয়। এছাড়া তুরস্কের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করার আহবান জানায় তারা।

সংলাপকেন্দ্রিক কূটনীতি, আলোচনায় চীন: দুদলকে সংলাপ বসানোর জন্য এক ধরনের কূটনীতি চলে সরকারের শেষ বছরে। মূলত ২০১৩ সালের বাংলাদেশ ঘিরে প্রায় সব কূটনীতিই ছিল নির্বাচনমুখি, সংলাপমুখি। প্রতিটি বন্ধুদেশই জাতিসংঘের মতোই বাংলাদেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র দেখতে চেয়েছে। এজন্য সহিংসতা এড়িয়ে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পথে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছে প্রত্যেকে। এমনকি প্রথা ভেঙে চীনও এবছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাথা ঢুকিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সুবিধাজনক ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীনের সরব হওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

প্রধান দু’জোটকে এক টেবিলে বসানোর জন্য আগে থেকেই কাজ করে যাওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনার পাশাপাশি তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুনও এখন আলোচিত নাম। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল রাজনৈতিক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে ঢাকা সফর করে সংকট নিরসনের জন্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের তাগিদ দেন। একই তাগিদে দুই নেত্রীকে চিঠি দিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদল: কূটনৈতিক পাড়ায় এ বছর আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদল হওয়া। সফরপ্রেমী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে স্থান পায় দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এএইচ মাহমুদ আলীর নাম। মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য এ পরিবর্তন বেশ আলোচিত হয়। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েই সরকারি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই ক্ষমতার চেয়ারে উপবিষ্ট হন তিনি।

দীপু মনির ক্লিন ইমেজে সেঞ্চুরি সফরের কালি: ক্ষমতার শুরুতে শান্ত মেজাজের দীপুমনির রাজনৈতিক ইমেজ নিয়ে টানাটানি না থাকলেও শেষ বছরে তিনি আলোচনায় আসেন প্রায় শতাধিক বিদেশ ভ্রমণের জন্য। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ২২ দিন পর থেকেই তার বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয়। দায়িত্ব শেষের আগেই পূর্ণ হয় ভ্রমণের  সেঞ্চুরি। এমনকি দায়িত্ব ছাড়ার পরদিনও। এসব সফরের বেশিরভাগই ছিল অপ্রয়োজনীয়। যেগুলোতে মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা গেলেই চলে সেখানেও দীপু মনি সফরের সুযোগ হাতছাড়া করেন নি বলে অভিযোগ ওঠে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও তিনি সরকারী টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়েছেন। এসব অভিযোগের কারণেই তিনি শেষমেষ প্রধানমন্ত্রীর সুনজর-বঞ্চিত হন এবং ছিটকে পড়েন নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে।

প্রণব মুখার্জির সফর: বছরের শুরুতে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সফরও ছিল আলোচিত। এ সফরে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাকে সম্মাননা জানানো হয়। মার্চের ৩ তারিখ ঢাকা সফর করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথমে বাংলাদেশ সফরের ইচ্ছাপূরণ করেন প্রণব। তবে তার তিন দিনের সে সফরে বিরোধী দল চরম অকৃজ্ঞতা দেখায় বন্ধুদেশের এ রাষ্ট্রপতিকে। সফর চলাকালীন হরতাল থেকে শুরু করে তার হোটেলের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের মত ঘটনাও ঘটায় তারা। এখানেই শেষ নয়, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎও বাতিল করেন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া। অথচ দেশটির দাওয়াতে ভারতে গিয়ে যথেষ্ট আপ্যায়িত হয়েই ফেরেন তিনি। বিশ্লেষকরা বলেন, রাষ্ট্রপতি প্রণবের সঙ্গে খালেদার এমন ব্যবহার ভালোভাবে নেয়নি দেশটি। এ সফরে এসে প্রণব মুখার্জি কথা দেন বাংলাদেশকে দেওয়া সকল প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে ভারত।

দায় মেটায়নি ভারত: ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নানা সুবিধা দিয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতকে তুষ্ট রাখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এসবের বিনিময়ে ভারতের কাছে চাওয়া ছিল তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি আর স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন। এ বছর ছিল সে পাওনা মেটানোর শেষ সুযোগ। কিন্তু বিরোধী দলের বাধার মুখে বাংলাদেশের সে দেনা মেটাতে পারে নি ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীসহ দেশটির সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বারবার প্রতিশ্রুতি সত্বেও ভারত বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের দায় মেটাতে পারেনি। মমতার বাধার মুখে তিস্তাচুক্তির বাস্তবায়ন থমকে যায় ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময়েই। আর অনেক বাধার পর শীতকালীন অধিবেশনের শেষ সময়ে ভারতীয় সংসদে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন বিল তুললেও তা পাশ হওয়া পর্যন্ত সময় পায়নি দেশটির ক্ষমতাসীন দল। আর তাই বাংলাদেশকে তার পাওনার খাতা খালি দেখতে হয়।
 
কোনো কিছু দিয়ে তুষ্ট করতে না পারলেও রাজনীতিতে অবদান রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখে ভারত। রাজনৈতিক ‍অস্থিরতার মধ্যেই এবছর বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। তফসিল অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি। বিরোধী দলসহ সরকারের শরিক জাতীয় পার্টিকেও নির্বাচনে অংশ নিতে আহবান জানান সুজাতা। এছাড়া বছরের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ঢাকা সফর করেন। সেসময় গণজাগরণমঞ্চের আন্দোলন চলছিল। একে মৌলবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান বলে তিনি এ মঞ্চের প্রতি সমর্থন জানান।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়ন: এবছর বাংলাদেশের কূটনীতিক অঙ্গনে বেশ নাটকীয়তা তৈরি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকরা। শুরু থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে তারা চাপের মধ্যে রাখে। কিন্তু বছরশেষে বিজয়দিবসে স্মৃতিসৌধের শ্রদ্ধা জানাতে না গিয়ে তারা আলোচনার জন্ম দেন। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সকল দেশের কূটনীতিকরা যোগ দেবেন এটাই রেওয়াজ। কিন্তু সে রেওয়াজ ভেঙে নিজেদের মধ্যে জরুরি বৈঠক করে ওই অনুষ্ঠানে নেদারল্যাণ্ডের একজন কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। তবে সরকারের অনুরোধে বিজয় দিবসের বিকেলে রাষ্ট্রপতির নিমন্ত্রণে যোগ দেন ইইউ’র সব রাষ্ট্রদূত। তবে বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি সরকারের উচ্চ মহল। এছাড়া শেষ সময়ে নির্বাচনে ইইউ’র পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তও সরকারকে খানিকটা হতাশ করেছে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক আনতে ব্যর্থ সরকার: ‌আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার অজুহাতে পর্যবেক্ষক পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরপরই পর্যবেক্ষক পাঠাতে না করে কমনওয়েলথ, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া। এদিক থেকে বলা যায়, সরকার পর্যবেক্ষক আনার কূটনীতিতে পুরোপরি ব্যর্থ হয়েছে।

দমে নি সরকার, বছরজুড়ে জবাব দিয়ে গেছে: বছরজুড়ে কূটনৈতিক চাপের মুখেও এতটুকু দমেনি সরকার। অনড় থেকেছে নিজেদের সিদ্ধান্তের প্রতি। আর তাই যুদ্ধাপরাধের বিচার ও কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরে বিদেশি চাপ পাত্তা পায় নি। পরিবর্তন হয়নি নির্বাচনের তারিখ। সরকার তফসিল অনুযায়ী এগিয়ে গেছে নির্বাচনের দিকে।

আর এসব পরিস্থিতিতে বিদেশি সমর্থনের জন্য বারবার জবার দেওয়া হয়েছে তাদের সকল প্রশ্নের। বর্ণনা করা হয়েছে প্রকৃত পরিস্থিতি। জানানো হয়েছে সরকারের সকল পদক্ষেপের উদ্দেশ্য।

এবছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বেশি সময়। দেশের ভিতরে কূটনীতিকদের ডেকে পরিস্থিতির যেমন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তেমনি বিদেশেও পাঠানো হয়েছে জবাব। যুদ্ধাপরাধের বিচার কেন প্রয়োজন, কিভাবে বিচার চলছে এসবই সরকার বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানিয়েছে বারবার। একই সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচনে আসার কারণ, জামায়াতের সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র সব‌ই জানানো হয়েছে বিদেশি বন্ধুদের।

বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা: অন্যান্য বছরের মত এবারও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য কয়েকজন বিদেশি বন্ধুকে সম্মাননা দেওয়া হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে দেওয়া সম্মাননা। এ বছরের তিনটি পর্বসহ মোট সাত পর্বে প্রায় তিনশ বন্ধুকে তাদের অকৃত্রিম অবদানের জন্য সম্মানিত করে সরকার।    

টিকফা চুক্তি: এবছর বহুল আলোচিত টিকফা চুক্তি (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ২৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২০০২ সালে এ চুক্তির খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হলেও আলোচনা শুরু হয় আরো আগে। দুর্নীতি, মেধাস্বত্ব ও শ্রমিকের অধিকার নিয়ে মতভেদ থাকায় এ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। শুরুতে এ চুক্তির নাম ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিণ্ন মহলের সমালোচনার মুখে ‘কো-অপারেশন’ শব্দটি যুক্ত করা হয় এবং ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ শব্দের পরিবর্তে ‘ফোরাম’ শব্দটি আনা হয়।

বছরজুড়ে কূটনীতিকরা বিভিন্ন রাজনীতিক মহল ও সুশীল সমাজের সঙ্গে গোপন বৈঠক চালায়। আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাশাপাশি নিবন্ধন বাতিল হওয়া দল জামায়াতের সঙ্গেও বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা। এবছরজুড়ে চলা সহিংসতার ঘটনায় অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জামায়াতের দেওয়া ক্ষতিপূরণ পায় যুক্তরাষ্ট্র। জানা যায়, এ ঘটনায় মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জামায়াত এর ক্ষতিপূরণ দেয়।

জিএসপি স্থগিত এবং আলোচনায় রানা প্লাজা: বছরের শুরুর দিকে পোশাকশিল্পের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম ঘটনা ছিল রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু। বিশ্বজুড়ে এ সময় আলোচিত হয় এ মর্মান্তিক ঘটনা। এর ফলে সকল কূটনৈতিক চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ বাজারসুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে দেশটি। এই সুবিধা ফিরে পেতে ১৬টি শর্ত জুড়ে দেয় ওবামা প্রশাসন। সে শর্তপূরণে শ্রম আইন সংশোধনসহ নানা উদ্যোগ নিলেও আজও যুক্তরাষ্ট্রকে তুষ্ট করতে পারে নি সরকার।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩
সম্পাদনা: খুররম জামান, ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাফেয়ার্স এডিটর/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।