ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যেও স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন!

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যেও স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন!

ঢাকা: সরকারে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরের শাসনামল শেষপ্রান্তে। তাই, সময় এসেছে আমলনামা নিয়ে ভাবারও।



পাঁচবছর ধরেই স্বাস্থ্যখাত সমালোচিত হয়েছে, রাজনৈতিক নিয়োগ, পদোন্নতি, অবহেলা আর নানা অনিয়মের জন্য। তবে সবকিছুর মধ্য দিয়েও স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য গত পাঁচ বছরে ছিল উল্লেখযোগ্য।
 
মাতৃমৃত্যু হ্রাস, শিশুমৃত্যু হ্রাস, পুষ্টির বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ উন্নতি করে যাচ্ছে ১৯৮০ সাল থেকেই। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি জোটে সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই বেশি।
 
গত নভেম্বরে স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রভাবশালী সাময়িকী ল্যানসেট বিশেষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের সাফল্যের।
 
ল্যানসেট বলেছে, দারিদ্র্য সত্ত্বেও স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশ ব্যতিক্রমী সাফল্য অর্জন করেছে। অপর্যাপ্ত অর্থায়ন, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও দারিদ্র্যের মধ্যেও নবজাতক ও পাঁচ বছরের কম বয়েসী শিশুদের জীবন রক্ষা, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, টিকাদান কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
 
ল্যানসেট সিরিজে বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি দারিদ্র্য বিমোচন ও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সম্পদ বৃদ্ধি। এ ধারণা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে বাংলাদেশ গত ৪০ বছরে স্বাস্থ্যখাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশি অগ্রগতি সাধন করেছে।

১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সময়ে মাতৃমৃত্যু ৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেকেরও বেশি কমে এসেছে এবং জনগণের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ দশমিক ৩ বছর, যা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানকেও ছাড়িয়ে গেছে।
 
এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া হয়, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড।
 
সিরিজে আরো বলা হয়, বাংলাদেশকে একটি তাত্পর্যপূর্ণ অবস্থানে উপনীত হতে সহায়তা করেছে এর বহুপক্ষীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যার মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও কাজ এবং গবেষণার সুযোগ পেয়েছে।

এতে করে ডায়রিয়ার চিকিত্সা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, ভিটামিন ‘এ’ এবং টিকাদান ব্যবস্থার মতো অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
 
ল্যানসেট বলছে, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যাপক তৎপরতায় যক্ষ্মা রোগে আরোগ্যের হার ৫০ শতাংশ থেকে উন্নীত হয়ে ৯০ শতাংশে পৌঁছেছে, বিশ্বে যা সর্বোচ্চ। মানুষের দ্বারে দ্বারে জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নারী স্বাস্থ্যকর্মী নিযুক্ত করার ফলে বাংলাদেশে উচ্চহারে (৬২ শতাংশ) জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে।

১৯৭১ সালে একজন নারীর শিশু জন্মদানের সংখ্যা ছিল ৬.৩, ২০১০ সালে যা ২.৩-এ নেমে এসেছে। উন্নয়নের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের সমকক্ষ অন্যান্য দেশে এ হার দেখা যায়নি।
 
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা লাভের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আট লাখ চিকিত্সক ও নার্সের অভাব রয়েছে।

সিরিজটিতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা লাভের উদ্দেশ্যে তাদের সরাসরি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এ জন্য অনিয়ন্ত্রিত, নিম্নমানসম্পন্ন ও ব্যয়বহুল বেসরকারি খাতের দ্রুত বিস্তার অনেকাংশে দায়ী।
 
শহরাঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যরক্ষা একটি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। গত ৪০ বছরে শহরে বসবাসকারী জনগণের হার ৫ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ হয়েছে। ফলে পানি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের চাপ পড়ছে।
 
তবে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ঝুড়িভর্তি প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন সব ক্ষেত্রে ছিল না। জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন না হলেও পদোন্নতি আর সুযোগ গ্রহণে সরকারদলীয় চিকিৎসকদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। প্রতি অর্থবছরেই ধারাবাহিকভাবে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দও কমেছে।
 
সরকারদলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চিকিৎসকদের নিয়োগে বাণিজ্য, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ও পরে তা প্রত্যাহার, জয়পুরহাটের হতদরিদ্র মানুষের কিডনি বিক্রি, কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের অপরিকল্পিত নিয়োগ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নির্বাচনে স্বাচিপের কারচুপির জয়, ওষুধনীতি, জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করতে না পারা, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর লাগামহীন ভর্তি ফি, গ্রামে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি, এ সবকিছুই স্বাস্থ্যখাতে সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতার পাল্লাকে ভারী করে তুলেছে।  
 
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকার প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পুনর্মূল্যায়ন করে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নবায়ন করা হবে।
 
নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের ক্ষমতাকালীন সময়ে নেওয়া পদক্ষেপের সূত্র ধরে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর প্রতিশ্রুতি ছিল।

এ পর্যন্ত সরকারি হিসাবেই ১১ হাজার ২৬২টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে মন্ত্রণালয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে এটা ছিল এ সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
 
নিয়োগ পরিকল্পনায় ত্রুটি থাকলেও ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ১৩ হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ ছিল সরকারের আরো একটি বড় পদক্ষেপ।
 
শুধু কমিউনিটি ক্লিনিকই নয়, গত পাঁচ বছরের স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে সরকারদলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) দাপটে মূল্যায়িত হননি অনেক জ্যেষ্ঠ এবং মেধাবী চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্যখাতের নিয়োগ নিয়ে স্বাচিপের জোরজবরদস্তি ছিল সমালোচনার অন্যতম বিষয়।
 
শুধু নিয়োগ বা পদোন্নতিই নয়, স্বাস্থ্যখাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নির্বাচনে কারচুপির আশ্রয় নিয়ে স্বাচিপের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান সভাপতি ও ইকবাল আর্সনাল মহসচিব নির্বাচিত হন।

চিকিৎসকদের নির্বাচনে এ ধরনের কারচুপি হতাশ করে দেশের মানুষকেও।
 
গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যের মধ্যে রয়েছে- মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ।
 
তবে দেশে ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে এ কয়েক বছরে। ২০১০ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর এবং ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অ্যানথ্রাক্স ও নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

এছাড়াও ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বাজারে বার্ড ফ্লুতেও আক্রান্ত হন এক ব্যক্তি।
 
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এই সরকার শেষ মুহূর্তেও ১৩টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়।
 
স্বাস্থ্যখাতে সরকারের আরো সফলতার মধ্যে রয়েছে, দেশের ছয়টি সিটি কর্পোরেশন এবং পাঁচটি পৌরসভায় ২৭টি নগর মাতৃসদন, ১৬৭টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ৬৫৬টি স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে দরিদ্র নগরবাসীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। এছাড়াও রাজধানীতে নতুন দুটি ৫০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণ।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।