ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

রোহিঙ্গা-ঢল ও ষোড়শ সংশোধনীর রায় সবচেয়ে আলোচিত দুই ঘটনা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭
রোহিঙ্গা-ঢল ও ষোড়শ সংশোধনীর রায় সবচেয়ে আলোচিত দুই ঘটনা কোলাজ ছবি

ঢাকা: সারাদেশে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আরও একটি বছর পার করলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। এবছর কোনো ধরনের বাড়তি রাজনৈতিক চাপ সরকারকে মোকাবিলা করতে না হলেও বেশ কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

এবছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিলো রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করা। এর পাশাপাশি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে বেশ রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ায়।

সরকার এ নিয়ে সৃষ্ট সার্বিক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
 
এ বছরই সরকারের বৃহৎ দুইটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে দৃশ্যমান সফলতা আসে। বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু করা পদ্মাসেতুর প্রথম স্প্যানটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় গত ১ অক্টোবর। এছাড়া গত ১ ডিসেম্বর দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মূল পর্বের কাজটি শুরু হয়।  

সরকারের চলমান জঙ্গি দমন অভিযান প্রায় সারা বছর জুড়েই অব্যাহত থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি দমনে সফল অভিযান চলে। এইসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে সরকার বেশ সফলভাবেই বছরটি পার করে।  

রোহিঙ্গা সংকট 
এবছর বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ ছিলো মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া। গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেদেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। নির্যাতিত এই রোহিঙ্গারা জলস্রোতের মতো সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসে কক্সবাজার এলাকায় অবস্থান নেয়। এদের আশ্রয়, খাদ্যের ব্যবস্থা এবং স্বদেশে ফেরত পাঠানো ছিলো সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিকভাবে আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা হলেও এদেরকে ফেরত পাঠানোর চ্যালেঞ্জ এখনও সরকার কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে শুরু থেকেই সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। যার ফলে সারাবিশ্বে এই নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ধিক্কার উচ্চারিত হয় এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে চাপ তৈরি হয়। অত্যন্ত ঝুকিঁ নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাবিশ্বে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে পরিচিতি পান। বিশ্বজনমত, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ ও বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে কিনা সে নিয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারছে না সরকার।  

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
পাবনার ঈশ্বরদীতে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। এটি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও ব্যয়বহুল প্রকল্প। রাশিয়ার উদ্ভাবিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং দেশটির অর্থায়ন ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে রাশিয়ার সর্বাধুনিক থ্রি প্লাস জেনারেশনের ভিভিইআর ১২০০ প্রযুক্তির পরমাণুচুল্লি ব্যবহার করা হবে। গত ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের মূল কাজ প্রথম কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর পারমাণবিক ক্লাবের ৩২ তম সদস্যদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি করপোরেশন ‘রোসাতম’ (ROSATOM)এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করাছে। মোট ২৪০০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শেষ করতে সাড়ে ৫ বছর সময় লাগবে। সে অনুযায়ী ২০২৩ সালের মাঝামাঝি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট এবং ২০২৪ সালে একই ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হবে।  

পদ্মাসেতুর স্প্যান স্থাপন
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের অগ্রাধিককার প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্প। চলতি বছরের ১ অক্টোবর পদ্মাসেতু নির্মাণের মূল অবকাঠামোর প্রথম স্প্যানটি স্থাপন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে পদ্মাসেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে সরকার নিজস্ব অর্থে এই পদ্মাসেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে। এই সেতুর নির্মাণ প্রকল্পে দুনীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিল করে দেয়। পরে বিশ্বব্যাংকের এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন প্রত্যাহার করে দিলেও নিজস্ব অর্থে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ২০১৯ সালে পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে তাতে যানবাহন চলাচল শুরু করার টার্গেট নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। এই পদ্মাসেতুর নির্মাণ আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য একটি বিরাট সফলতা।
 
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ছিলো একটি বড় আলোচিত ঘটনা। গত ৭ থেকে ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। এসময় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিসহ সেদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসময় শেখ হাসিনাকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অর্ভূতপূর্ব সম্মান জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ঘিরে প্রায় এক মাস আগে থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রতিবেদন, মন্তব্য প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশ হতে থাকে। শেখ হাসিনার এই সফর দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক সম্পর্কটি এক নতুন মাত্রায় ও উচ্চতায় নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে দুই দেশের মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন চুক্তি এবং সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। তবে তার সফরের একটি অপূর্ণতাও রয়েছে। বহুল আলোচিত ও বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশিত তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তিটি ঝুলে থাকে। এই ইস্যুতে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মতানৈক্যের ফল হিসেবেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি।
  
জঙ্গি দমন অভিযান
এবছরও একের পর এক জঙ্গি তৎপরতা মোকাবিলা করতে হয় সরকারকে। হলি আর্টিজানের মতো বড় কোনো নেতিবাচক ঘটনা না ঘটলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জঙ্গি দমনে সফলতা দেখায়  আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ৬ মার্চ টঙ্গীতে প্রিজন ভ্যানে জঙ্গি হামলা চালিয়ে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টার মাধ্যমে এ বছরে জঙ্গি তৎপরতার শুরু। এরপর কুমিল্লার কোটবাড়ী, চট্রগ্রামের সীতাকুণ্ড, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, মৌলভীবাজারের বড়হাট ও নাসিরপুর, ঢাকায় বিমানবন্দরে কাছে আসকোনাসহ ঝিনাইদহ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি তৎপরতা ও জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়ে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী অভিযান চালায়। এইসব অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে সরকার জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি জঙ্গিদের সব নাশকতার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিতেও সক্ষম হয়।

আইপিইউ ও সিপিএ সম্মেলন
বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারক-বাহক দুই বৃহৎ সংগঠন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন(আইপিইউ) এবং কমনওয়েলথ্ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন(সিপিএ) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। এর আগে এতো বড় কোনো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান বাংলাদেশে হয়নি। এটা বাংলাদেশের জন্য ছিলো অনেক বড় ঘটনা। আর তাছাড়া রাজনৈতিক দিক থেকেও এটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের জন্য বিশাল অর্জন। গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় সংসদ। এই ১০ম সংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার নিয়ে দলটির বিরোধী পক্ষ থেকে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল থেকে নানা প্রশ্ন তোলা হয়। তবে এই সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সিপিএ-এর চেয়ারপারসন এবং সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী আইপিইউ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে এই দুইটি সংগঠনের সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে নির্বাচন ও সরকার নিয়ে সকল প্রশ্ন ও সমালোচনার অবসান ঘটে। গত ২ থেকে ৮ অক্টোবর সিপিএ এবং ১ থেকে ৫ এপ্রিল আইপিইউ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
 
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে উত্তাপ
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণাকে বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশ হয়। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিতে সংবিধানে এই সংশোধনী আনা হয়েছিলো। এই সংশোধনীর ওপর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতাসহ কিছু বিষয় নিয়ে যে মন্তব্য করা হয় তাতে ঘোর আপত্তি তোলে আওয়ামী লীগ ও সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মহল। এই রায়কে ঘিরে চলতে থাকা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ছুটিতে যান। এরপর প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেন। গত ২৪ ডিসেম্বর ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার(রিভিউ) জন্য রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭ 
এসকে /জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।