ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

একাত্তর

ভুট্টোর ষড়যন্ত্র ও ইয়াহিয়ার ‘দোয়া’

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬
ভুট্টোর ষড়যন্ত্র ও ইয়াহিয়ার ‘দোয়া’

ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক চলাকালে মিত্রবাহিনী গভর্নমেন্ট হাউসে আক্রমণ করে। গভর্নর তার মন্ত্রী ও সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে...

ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক চলাকালে মিত্রবাহিনী গভর্নমেন্ট হাউসে আক্রমণ করে। গভর্নর তার মন্ত্রী ও সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরে ‘হোটেল শেরাটন’ এবং বর্তমানে ‘হোটেল রূপসী বাংলা’) আশ্রয় নেন।

এদিকে লে. জেনারেল নিয়াজি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদের সাথে যোগাযোগ করে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ অবস্থা জানালেন।
 
এরও দুই দিন আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরের ১২ তারিখ পাকিস্তানি বাহিনী রাওয়ালপিন্ডির কাছে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাঠাতে তৎপর হয়ে ওঠে। প্রস্তাবটি ঠিক কে পাঠাবে তা নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারের অফিসে দেনদরবার চলছে। সাব্যস্ত হয়, জেনারেল রাও ফরমান আলীই প্রস্তাবটি গভর্নরের কাছে পাঠাবেন। গভর্নর যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবটি পেয়ে সেটি প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
 
এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশনের জন্য কমান্ডার নিয়াজি ও তার বাহিনীর সদস্যদের প্রশংসা করলেন। সেই সঙ্গে ইয়াহিয়া বলেন, ‘সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য একজন মানু্ষের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব,আমি তার সবই করেছি(!)। আপনি (নিয়াজি)এখন এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়’। তাই ইয়াহিয়া তাকে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিলেন। সেই সঙ্গে তিনি যে আত্মসমর্পণ ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিরাপত্তার বিষয়ে জাতিসংঘ তথা মিত্রবাহিনীর সাথে আলাপ-আলোচনা করছেন সেটিও নিয়াজিকে জানালেন।  
 
আত্মসমর্পণ বিষয়ক ইয়াহিয়ার এ বার্তাটি ঢাকায় পৌঁছায় ১৪ ডিসেম্বর বিকাল পাচঁটার দিকে।  
 
নিয়জির বাহিনী একদিকে পরাজয় নিশ্চিত জেনে আত্মসমর্পণের জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছিল, অন্যদিকে বুদ্ধিজীবী হত্যা করে ইতিহাসের জঘন্যতম প্রতিহিংসায় মেতে উঠেছিল এই ১৪ তারিখে। ইতিহাসে এমন নজির আর একটিও নেই।
 
নিয়াজিকে ১৪ তারিখে পাঠানো বার্তায় ইয়াহিয়া বরাবরের মতো এবারও মিথ্যাচারই করলেন। তিনি বললেন যে, সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য যা কিছু করা সম্ভব, তিনি তার  সবই করেছেন। কিন্তু এ যুদ্ধাবস্থার সূচনা করেছেন তিনি নিজেই। রাজনৈতিক সংকট যদিও আরো আগেই শুরু হয়েছে। সে সংকট সমাধানযোগ্য ছিল। কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তিনি রাজনৈতিক সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছেন। ইতিহাস যদিও জানান দেয়, রাজনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করতে ইয়াহিয়ার চেয়ে ভুট্টোর ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। ভুট্টো এ কাজে টিক্কা খানকে ব্যবহার করেছেন। ভুট্টোর এ ষড়যন্ত্রের কথা পরে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ততোদিন ইতিহাসের এক অমোঘ নিয়মেই বাংলার আকাশে নতুন পতাকা উড়ত শুরু করেছে। ভুট্টোর ‘এ ধার হাম, ও ধার তুম’ষড়যন্ত্র-তত্ত্বই বাস্তবায়িত হলো শুধু তা অখণ্ড পাকিস্তানে নয়।
 
সত্য কখনো চাপা থাকে না। সত্য আপন মহিমায় সদা জাগরুক। পরবর্তীকালে নিয়াজি, ভু্ট্টো, টিক্কা, ইয়াহিয়া সবার বয়ানেই সত্য বেরিয়ে এসেছে। নিয়াজির লেখা The Betrayal of East Pakistan, রাও ফরমান আলীর লেখা How Pakistan Got Devided, সিদ্দিক সালিকের লেখা Witness to Surrender,জেনারেল ফজল মুকিমের লেখা Pakistan’s Crisis in Leadership, মেজর জেনারেল শওকত রিজার লেখা Pakistan Army-1966-71-সহ অনেক বই ও নথিপত্রে বেরিয়ে এসেছে সেসব ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারের কথা।
 
একাত্তরের ২ এপ্রিল সেনাপ্রধান আবদুল হামিদ টিক্কা খানকে সরিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার নিয়োগ করেন লে.জে. এ এ কে নিয়াজিকে। এই নিয়াজি কমান্ডার থাকাকালীনই একাত্তরে আমাদের এতো রক্তক্ষয়-জীবনদান।
 
নিয়াজি তার বইতে সাক্ষ-প্রমাণ দিয়ে দাবি করেছেন, তদানীন্তন ইয়াহিয়া সরকার ভুট্টোর পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে পূর্ব-পাকিস্তানে সংকট সৃষ্টি করেছে। ভু্ট্টো শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই ভুট্টো ইয়াহিয়াকে ইন্ধন জুগিয়েছেন আর টিক্কাকে একাজে ব্যবহার করেছেন।
 
১৯৭০ এর নির্বাচনের পর ভুট্টো তার অধীনস্থ এক কর্মকর্তাকে দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করান যাতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তান টিকে থাকতে পারবে।
 
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নিয়ে তারা এ সংকট আরো ঘনীভূত করেন। ‘৭১এর ফেব্রুয়ারিতে জেনারেল ওমর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকদের ঢাকায় আসতে নিষেধ করলেন। শুধু তাই নয়, ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব এমএলএ ঢাকায় আসবেন তাদের কঠোর শাস্তি দেয়ার হুমকিও দেন। এভাবে ভুট্টো-ইয়াহিয়া-টিক্কা-ফরমান আলী মিলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এমন একটি জায়গায় নিয়ে যান যেখান থেকে আমাদের আর পেছনে তাকানোর সুযোগ ছিল না।
 
আসলে সামরিক জান্তা যদি শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর পরিচালক হয় তখন যেকোনো সাধারণ রাজনৈতিক সংকটও জটিল হয়ে উঠতে পারে। কারণ, রাজনৈতিক সংকটের রাজনৈতিক সমাধানই হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্র রাজনৈতিক সংকটকে  সামরিক কায়দায় সমাধান করতে চেয়েছে। একারণে এ সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে।
 
ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের আরো নজির হলো, তিনি এক ভাষণে শেখ মুজিবকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘এ ধার হাম, ও ধার তুম’। এথেকেই তার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পৃথক হয়ে যাওয়ার গোপন ইচ্ছাটি প্রকাশ পায়। কিন্তু পাকিস্তানিরা এর দায় চাপিয়েছে বাঙালিদের ওপর। নিয়াজির বইতে পাই, ‘ভুট্টো অখণ্ড পাকিস্তানে বিরোধী দলীয় নেতার ভুমিকা পালনে প্রস্তুত ছিলেন না’। গণতন্ত্রের প্রতি তার আস্থাহীনতাই এর কারণ। তিনি শুধু চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হতে, বিরোধী দলীয় নেতা নয়।  
 
ভুট্টোর এ ষড়যন্ত্রের আরো নমুনা আছে। লারকানায় ভুট্টো-ইয়াহিয়া বৈঠকে এ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। সেখানে যে পরিকল্পনা হয় তা‘এম.এম. আহমদ পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। লারকানা ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই শুরু হয় অপারেশন সার্চ লাইট।
 
এভাবে পাকিস্তানি শাসকচক্রের একের পর এক ষড়যন্ত্র ও হঠকারী সিদ্ধান্তের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে ২৫ মার্চ গণহত্যার শুরু- যা ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে, ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে, টিক্কা ও রাও ফরমান আলীর কমান্ডে পরিচালিত হয়। টিক্কার পরে এই কমান্ডের দায়িত্ব অর্পিত হয় নিয়াজির ওপর। নিয়াজি বাকি আট মাস একই কায়দায়  বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠেন।
 
আসলে পাকিস্তানি শাসকচক্র সরল পথ অনুসরণ করেনি, তারা সবসময়ই ষড়যন্ত্র ও টালবাহানার পথ অনুসরণ করেছে। ফলে, একাত্তরে শাসনতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়,বাঙালিকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তারা এর সমাধান চেয়েছে। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। তারা সমস্যা সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সমাধান করতে পারেননি।
 
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পূর্ব-পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে ইয়াহিয়াকে অবহিত করা হলে তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমি কী করতে পারি? আমি কেবল দোয়া করতে পারি’। ইয়াহিয়া কী দোয়া করেছিলেন জানি না, তবে বাঙালি রক্তের দামে স্বাধীনতা পেয়েছে।  
 
বাংলাদেশ সময়: ১১০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।