ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

একাত্তর

জ্ঞান ফিরে দেখি বাম হাতটা নেই

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
জ্ঞান ফিরে দেখি বাম হাতটা নেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন। ছবি: খোরশেদ আলম সাগর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কোনোমতে হাতটাতে গামছা বেঁধে এক হাতেই অস্ত্র চালিয়ে হানাদারদের গুলির জবাব দিয়েছি। এরপর কখন যে সহযোদ্ধারা হাসপাতালে নিয়েছেন বলতেই পারি না। জ্ঞান ফিরে দেখি বাম হাতটা নেই।

লালমনিরহাট: কোনোমতে হাতটাতে গামছা বেঁধে এক হাতেই অস্ত্র চালিয়ে হানাদারদের গুলির জবাব দিয়েছি। এরপর কখন যে সহযোদ্ধারা হাসপাতালে নিয়েছেন বলতেই পারি না।

জ্ঞান ফিরে দেখি বাম হাতটা নেই।

কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি ইউনিয়নের চরিতাবাড়ি গ্রামের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন (৬২)।
 
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় টগবগে তরুণ আমির হোসেন স্থানীয় কুমড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পাক হানাদার ও তার দোসররা গ্রামের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। এসব দৃশ্য তাকে চরমভাবে ব্যথিত করে। একপর্যায়ে তিনি ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে ছুটে যান ভারতের শিলিগুড়ি মুজিব ক্যাম্পে।

সেখানে একমাস প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অস্ত্র ধরেন ৭ নং সেক্টরের অধীনে দিনাজপুর অঞ্চলে। দেশ মাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করতে সেখানে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন আমির হোসেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেনের বাবার কাছে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠি৭১ সালের বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন জানান, হিলি বন্দর এলাকায় পাক হানাদারদের ক্যাম্পে একদিন অভিযান চালায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী, চলে তুমুল যুদ্ধ। সেদিন মিত্রবাহিনীর বুলেটের জবাবে হানাদার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়ে দূরে আত্মগোপন করে। তখন মিত্রবাহিনী পাক হানাদারদের ওই ক্যাম্প দখলে নেয়। এরই মধ্যে পাকিস্তানী সেনারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে চারদিক থেকে মিত্রবাহিনীকে আক্রমণ করে। এদিন মিত্রবাহিনীর অসংখ্য সৈনিক শহীদ হন।

এ হামলার খবরে পুনরায় মিত্র ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে হিলি থেকে নিশ্চিহ্ন করে হানাদারদের।

বিজয়ের প্রান্তলগ্নের স্মৃতিচারণে আমির হোসেন জানান, ডিসেম্বরের শুরুতে দিনাজপুরের কয়লাডাঙ্গীর পাকিস্তানী সেনাদের ঘাঁটিতে রাতভর আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। সেদিন ৩জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন আর আহত হন ২৩ জন সহযোদ্ধা। সারারাত অস্ত্র চাল‍ানোর পর ক্লান্ত আমির হোসেন ভোরের দিকে তার ব্যবহৃত ৭.৬২ এলএনজি’র বেরেল অস্ত্রটি হাত বদল করতে গেলে শত্রুদের একটি গুলি লাগে তার বাম হাতের কনুইয়ের উপরে।

আমির হোসেন বলেন, মাথা ঘুরিয়ে দেখি, বাম হাতটা ঝুলে আছে, অঝোরে রক্ত ঝড়ছে। গামছা পেঁচিয়ে শক্ত করে হাত বেঁধে শুধুমাত্র ডান হাতেই অস্ত্র চালিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হানাদারদের গুলির জবাব দিয়েছি।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেনের সঙ্গে আলাপরতএরপর কিছুই বলতে পারি না। জ্ঞান ফিরে দেখি বাম হাতটা নেই। শুয়ে আছি ভারতের বালুরঘাট হাসপাতালে। সেখানেই শুনতে পাই প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হয়েছে। পরে সেখান থেকে খিরকী হাসপাতালে ৯ মাস চিকিৎসা নিয়ে সোজা চলে যাই ঢাকায় প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করতে। সেদিন বঙ্গবন্ধু বকশিস হিসেবে টাকা দিয়েছিলেন। তবে পরিমাণটা মনে নেই, যোগ করেন আমির হোসেন।

আমির হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েই বসে থাকেন নি। নিয়মিত সৈন্যদের খবর নিতেন। ভারতের হাসপাতালে চিঠি পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে বাড়ির খবর জানিয়েছেন। চিন্তিত বৃদ্ধ বাবাকে হাসপাতালের খবরটাও চিঠির মাধ্যমে পাঠিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সঙ্গে ৫শ’ টাকার একটি চেক। সে চিঠিগুলো আজ শুধুই স্মৃতি।

দেশ স্বাধীন হয়েছে শুনে হাত হারানোর বেদনাও ভুলেই গেছি। এক হাতে কাজ করছি তবুও কষ্ট লাগে না। তবে দুঃখ হয়, যখন অভিভাবকতুল্য বঙ্গবন্ধুর ওইসব স্মৃতি মনে পরে। প্রিয় নেতাকে হারানোর বেদনায় কান্না করি এখনও।

যুদ্ধে বাম হাতটা হারিয়ে সম্পূর্ণরূপে কর্মহীন হয়ে পড়েন আমির হোসেন। বাবার পৈত্রিক সম্পত্তির আয়েই চলত স্ত্রীসহ ৪ ছেলে মেয়ের সংসার। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি ভাতায় চলছে এক ছেলে ও এক মেয়ের লেখাপড়া। তবে এই প্রথম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানির জন্য মনোনীত হন তিনি। এ জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান আমির হোসেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।