ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শেয়ারবাজার

শেয়ারবাজারে সক্রিয় সঙ্ঘবদ্ধ চক্র!

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৫
শেয়ারবাজারে সক্রিয় সঙ্ঘবদ্ধ চক্র!

ঢাকা: শেয়ারবাজারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একাধিক গ্রুপভিত্তিক বিনিয়োগকারী চক্র। এরা পারস্পরিক যোগসাজসে কোনো বিশেষ কোম্পানির শেয়ারের দাম ওঠা-নামানোর অপতৎপরতায় লিপ্ত।


 
গত তিন মাসে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারে গ্রুপভিত্তিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ফায়দা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব চক্রে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, বড় বিনিয়োগকারী ও এক সময় সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন এমন ব্যক্তিরাও রয়েছেন।
 
বিনিয়োগের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের জন্য এসব চক্রের সদস্যরা প্রথমে কোন নির্দিষ্ট কোম্পানির শেয়ারকে টার্গেট রেঁ থাকেন। এরপর নানা কৌশলে ওই কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়েনোর পাঁয়তারা চালান।
 
পরিকল্পনামাফিক কোম্পানিটির শেয়ারের দাম নিজেদের লক্ষ্যমাত্রার (কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কতো টাকা পর্যন্ত উঠবে আগে থেকেই তার আনুমানিক একটি গ্রুপিং সিদ্ধান্ত) কাছে এলে এই চক্রের লোকেরা নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে সরে পড়ছেন। কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শেয়ারের দাম বাড়াতে বিশেষ ফেসবুক পেজও ব্যবহার করছেন এসব চক্র।
 
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের শেয়ারবাজার আকার খুব ছোট। বাজারে বেশ কিছু ছোট কোম্পানি (কম মূলধনের কোম্পানি) আছে। এসব কোম্পানির শেয়ারে গ্রুপভিত্তিক বিনিয়োগ করে দাম বাড়ানো অথবা কমানো যায়। আমাদের মতো ছোট বাজারে এমনটি হতেই পারে। তবে বাজার বড় হলে এ ধরনের অপচেষ্টা চালানো খুবই কঠিন। ’
 
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক রিসার্চ কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ‘কিছু চক্রের মাধ্যমে যে শেয়ারবাজার প্রভাবিত হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে। জানুয়ারি থেকে যদি বাজারের ট্রেন্ড দেখি তাহলে দেখা যাবে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। অথচ ভালো মুনাফা দিচ্ছে এমন কোম্পানির শেয়ারের দাম তেমন একটা বাড়ছে না। ’
 
এদিকে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বড় বিনিয়োগকারী ও প্রভাবশালী একাধিক ব্রোকারেজ হাউস’র মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জর (সিএসই) সদস্য ব্রোকারেজ হাউসের সিংহভাগ মালিক পক্ষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত।
 
এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্রোকারেজ হাউস মালিকরা বিএনপি-জামায়াতপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের। বাকি ব্রোকারেজ হাউস মালিকরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে সরাসরি আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি-জামায়াত কোনো ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন হাউস-মালিকও রয়েছেন কয়েকজন।
 
তারা জানান, ১৯৯৬ সালের আগে থেকে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার রাজনীতিকরণের চিত্র অনেকটাই প্রকাশ্য রূপ নেয়।
 
ওই সময় সরকারকে বিপাকে ফেলতে আওয়ামী লীগবিরোধী কিছু বড় ব্যবসায়ী এবং একই মতাদর্শের ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো নানা তৎপরতা চলায়। নতুন করে বিনিয়োগে আনা হয় ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় তিন মাস ধরে এ টাকা বিনিয়োগ করে চক্রটি।
 
তাদের তৎপরতার কারণেই ২০১০ সালে শেয়ারবাজর অস্বাভাবিক ফুলে-ফেঁপে ওঠে। অবশ্য শেয়ারবাজার অস্বাভাবিক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলতে সরকার দলীয় বেশকিছু ব্যবসায়ীরাও ভূমিকা রাখে। মুনাফার লোভে চক্রটির ফাঁদে পা দেন সরকার দলীয় ব্যবসায়ীরা।
 
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১০ সালের মহাধসের সময় বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে নিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করতে একযোগে শেয়ার বিক্রি শুরু করে চক্রটি। আর তাদের এমন অপতৎপরতায় মহাধসের কবলে পড়ে দেশের শেয়ারবাজার। ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন সেই ধসের কবল থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি শেয়ারবাজার।
 
শেয়ারবাজারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে ২০১০’র পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে চক্রটি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজরে টানা পতন ঘটাতে এ চক্রটি কয়েক মাস ধরেই তৎপরতা চালায়।
 
আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী মতাদর্শের ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে ওই সময় (২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল সময়ে) নিজেদের পোর্টফোলিওতে শেয়ার ক্রয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দেয়। একই সঙ্গে বিনিয়োগের জন্য আসা বিনিয়োগকারীদেরকেও নানাভাবে নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালায়।
 
তবে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ায় এবং মে মাসে সরকারের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শেয়ারবাজার নিয়ে ইতিবাচক কথা বলায় বদলে যায় শেয়ারবাজারের চিত্র। পতনের বৃত্ত থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসে শেয়ারবাজার।
 
ডিএসইর একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ডিএসইর এমন কিছু সদস্য আছেন যারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে নিজেদের ব্যবসা ধ্বংস করতেও প্রস্তুত ছিলেন। এসব ব্রোকার মালিকরা ২০১০ সালে ও চলতি বছরেও সেই তৎপরতা চালিয়েছেন। বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণে তারাও এখন বিনিয়োগে সক্রিয় হয়েছেন।
 
কট্টর বিএনপি-জামায়াতপন্থি এমন ব্যবসায়ীরাও এখন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করছেন। নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত এমন ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও সম্মেলিতভাবে বিনিয়োগ করছেন এদের অনেকে।
 
ফলে বিভিন্ন পক্ষের সক্রিয়তার টানা দরপতন ও লেনদেন-খরার বৃত্ত থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে শেয়ারবাজার। প্রায় তিনমাস ধরে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ৩’শ কোটি টাকার ঘরে নেমে যাওয়া লেনদেন ৯’শ কোটি টাকার ওপরে চলে এসেছে।
 
ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বাংলানিউজকে বলেন, বাজার এখন ইতিবাচক রয়েছে। তবে তালিকাভূক্ত কোম্পানিগুলো কেমন করছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা দিতে পারলে বাজারে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব পড়েবে।
 
তিনি বলেন, ২০১০ সালের পর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক কিছু করা হয়েছে। আর কতো? ৫ বছরতো হয়েই গেছে। হরতাল-অবোরোধ করে কোনো উদ্দেশ্য সাধন হবে না এটি বিএনপি বুঝে ফেলেছে। সুফল পেতে হলে তাদেরকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে আসতে হবে। আর ব্যবসায়ীরা তো বছরের পর বছর লোকসান দেবে না। তাদের ব্যবসাও টিকিয়ে রাখতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাটাও শেয়ারবাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক ঘটনা।
 
বাজার-মূলধন: চলতি বছরের প্রথম কার্যদিবস ১ জানুয়ারি ডিএসইর বাজারমূলধন ছিলো তিন লাখ ২৯ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। টানা দরপতনে এক পর্যায়ে ৪ মে ডিএসইর বাজার মূলধান নেমে আসে দুই লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকায়। আর বাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরার কারণে ৫ আগস্টের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪০ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকায়।
 
সূচক ও লেনদেন: বছরের শুরুর দিন ডিএসইএক্স সূচক ছিলো ৪ হাজার ৯৪১ পয়েন্টে। মে মাসে তা কমে ৩ হাজার ৯৫৯ পয়েন্টে চলে আসে। ৪ আগস্টের লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স সূচক দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৭৩ পয়েন্টে।
 
আর ২’শ ও ৩’শ কোটি টাকার ঘরে নেমে যাওয়া লেনদেন চলে এসেছে ৯’শ কোটি টাকার ওপরে। শেষ ১১ কার্যদিবসের ২ দিনই ৯’শ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। ৮’শ ও ৭’শ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে ৩ দিন করে।
 
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে: বিনিয়োগে বিরত থাকা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারে সংক্রিয় হযে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শেয়ার লেনদেন করছেন বলে একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
 
আতঙ্ক কাটছে বিনিয়োগকারীদের: টানা দরপতনের আতঙ্কে থাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গত দুই মাসের বাজারচিত্র অনেকটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে। অনেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নতুন করে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছেন। তবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই এখনো গুজবভিত্তিক বিনিয়োগ করছেন।
 
বেড়েছে বিদেশি বিনিয়োগ: সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে, জুন মাসে শেয়ারবাজারে নিট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১০১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অথচ আগের তিন মাস টানা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয় বিদেশিরা। ওই সময় (মার্চ, এপ্রিল ও মে মাস) ১৮৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হয়। সদ্য সমাপ্ত জুলাই মাসেও বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসইর নির্ভরযোগ্য সূত্র।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।