সময়টা ছিল চৈত্র মাস। দেশে তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তখন তারামন বিবি অনেক ছোট। বয়স আনুমানিক হবে ১৪-১৫। তারামন বিবির মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে মুহিব হাবিলদার ধর্ম মেয়ে করে নেন। এ ক্ষেত্রে অনেকটা সহায়তা করেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আজিজ মাস্টার।
এরপর তারামন বিবি চলে যান কোদালকাঠির দশঘরিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে রান্না করা, খাবার ডেক পরিষ্কার আর অস্ত্র পরিষ্কার করার কাজ শুরু করেন। এটি ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি যুদ্ধ ক্যাম্প। শুরু হয় তার যুদ্ধের জীবন।
তারামন বিবি ১১ নম্বর সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন। তখন ১১ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্না-বান্নার জন্য নিয়ে আসেন।
তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তীতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনো শেখান। পরবর্তীতে সহকর্মীদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারামন বিবি গোয়েন্দা তথ্য আনতে বেরোলে মাথায় গোবর লাগিয়ে, মুখে কালি দিয়ে উপুড় হয়ে গড়াতে গড়াতে শত্রুর কাছাকাছি চলে যেতেন। কোথায় শত্রুর অস্ত্র আছে, কোথায় অপারেশন চালাতে হবে, এসব তথ্য এনে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তারামন বিবির কথার সূত্র ধরে এরপর শুরু করতেন পরিকল্পনা মাফিক অপারেশন। এভাবে কাজ করতেন তিনি। তারামন বিবিসহ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই দেশকে স্বাধীন করে। পরে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৯৪। গেজেটে নাম মোছাম্মৎ তারামন বেগম। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি’দে প্রথম তার সন্ধান পান। এরপর নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ কার কয়েকটি সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তার হাতে তুলে দেন।
দীর্ঘদিন ধরে বক্ষব্যাধিসহ নানা রোগে ভুগছিলেন তারামন বিবি। ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর দিবাগত রাত দেড়টার দিকে নিজবাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরে বীরকন্যা তারামন বিবিকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বীরকন্যা বীরপ্রতীক তারামন বিবির বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।
আজ রবিবার (১ ডিসেম্বর) বীর প্রতীক তারামন বিবির মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুর আগে বসুন্ধরা শুভসংঘর রাজিবপুর উপজেলা শাখার উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বসুন্ধরা শুভসংঘর কাজে শুভ কাজের নানা পরামর্শ দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় বসুন্ধরা শুভসংঘর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল সম্মাননা স্মারক। মহান মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য অবদান রাখায় এই বাঘিনী কন্যার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজিবপুর সরকারি কলেজ শাখার উদ্যোগে সকাল ১১টায় বীর প্রতীক তারামন বিবির পারিবারিক করবস্থানে ফুলেল শ্রদ্ধা ও দোয়ার আয়োজন করা হয়। দোয়া পরিচালনা করেন উপজেলা তালতলা মাদরাসার মাওলানা মোজাম্মেল হক।
দোয়া অনুষ্ঠানে বীর প্রতীক তারামন বিবির একমাত্র ছেলে আবু তাহেরসহ উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা শুভসংঘ রাজিবপুর সরকারি কলেজ শাখার সহসভাপতি মাসুদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক শামিম আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ মাহমুদ, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদুর রহমান, শুভসংঘর সদস্য রাসেল রাজ, রায়হান, সোহেল রানা, আসিফ, হৃদয়, মামুন, রিপন, মিসকাতুল মিরাজ প্রমুখ।
তারামন বিবির ছেলে আবু তাহের দুঃখ করে বলেন, ‘রংপুর শহর থেকে উপজেলা শহর পর্যন্ত বীর প্রতীক তারামন বিবির নামে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। শুনেছি কুড়িগ্রাম জেলায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। আমি এই সরকারের কাছে দাবি করি আমার মায়ের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আমার মায়ের নামে বীর প্রতীক তারামন বিবি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা হোক। ’ এ সময় বসুন্ধরা শুভসংঘ কর্তৃক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও দোয়া অনুষ্ঠান আয়োজন করায় ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২১১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০২৪
এমজে