তার দাদাকে খাবলে খেলো সুন্দরবনের এক মানুষখেকো বাঘ। ভাইকে যে বাঘ আক্রান্ত করে সেই বাঘটিকে মারতে গিয়ে ফের আক্রমণের শিকার হন আরেক দাদা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের কথা। সে আমলে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলো ছিল অনেকটা জনশূন্য। সুন্দরবন সংলগ্ন এমন এক প্রত্যন্ত এলাকায় জঙ্গল কেটে আবাস গড়েন পচাব্দি গাজীর পূর্বপুরুষরা। কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্যখানে। দক্ষিণে খোলপেটুয়া নদী পেরুলেই ছিল সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল। সঙ্গে সব মানুষখেকো বাঘ। সেই বাঘের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে গিয়েই বিখ্যাত শিকারি বনে যান পচাব্দি গাজী। যার শিকারে ঝুলিতে রয়েছে ৫৮টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। জিম করবেটের মতো আধুনিক অস্ত্র থাকলে না জানি তিনি কি করতেন।

বাঘ শিকারের পর পচাব্দি গাজী। ছবি তার ছেলের বাড়ি থেকে সংগৃহীত
ভাতিজি ঈমান আলী অনেক শিকারে সঙ্গী হয়েছিলেন পচাব্দির। তার মুখেই গাজীর বাড়িতে চললো সুন্দরবনের রাজা রয়েল বেঙ্গল শিকারের সব রোমহর্ষক গল্প।সমস্ত সুন্দরবনজুড়ে মানুষখেকো বাঘ শিকার করেছেন এ শিকারি। ত্রিশের বেশি বাঘ শিকার করা বাবাকে টপকে দক্ষ শিকারি হিসেবে নাম কুড়ালেন দ্রুত। যে এলাকায় বাঘ মানুষ খেতো, ডাক পড়তো তার। পাকিস্তানি শাসকদের বিলাসিতা পূরণেও তাকে বাঘ মারতে হয়েছে। বাঘ মানুষ খেতো। কিন্তু বাঘ শিকার করতে করতে তিনি উল্টোই যেন ওয়ে ওঠেন ‘বাঘখেকো’ এক শিকারি।
দক্ষিণ তালপট্টিতে শিকার করা সাড়ে ১৪ ফুট লম্বা রয়েলে বেঙ্গল টাইগারটিই তার সবেচেয়ে বড় শিকার। শিকারের অসংখ্য পদ্ধতি জানা ছিল পচাব্দি গাজীর। মানুষখেকো বাঘ দেখলেই চিনতেন। চিনতেন পায়ের ছাপ দেখলেও। তখন মানুষখেকো বাঘ মারার অনুমতি ছিল। কারণ বাঘের বেশি বিচরণ সুন্দরবনের সম্পদ আরোহণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতো।

শিকারি বেশে পচাব্দি গাজী। ছবি তার ছেলের বাড়ি থেকে সংগৃহীত
গাবুরা থেকে ঘণ্টা পাঁচেক দূরত্বের ভেদাখালী পচাব্দির ভাই হাসেম আলী গাজী, বড়ছেলে আমজাদ আলীকে নিয়ে শিকারে যান। বনে বাঘের পায়ের ছাপ দেখলেই তারা বুঝতে পারতেন বাঘটি কত বড়, শিকারি কিনা। অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলে বন্দুকের ফাঁদ পাতেন। নিশানা এতো সঠিক ছিলো যে ফাঁদে পড়লে কোথায় গুলিটি লাগবে তা আগে থেকেই বলে দিতে পারতেন। বাঘ সব জায়গায় চলে না। একটি নির্দিষ্ট এলাকা দিয়েই চলে। সেটাও জানতেন তারা। আর গলা ও হৃদপিণ্ডে না গুলি লাগলে মরে না। ফাঁদে পড়ে ঠিকই গুলি লাগলো। এবং মারা গেলো বাঘটি।ঈমান আলীর দাদাও ছিলেন শিকারি। চোয়ালের এক পাশ খাবলে খেয়ে নেয় বাঘ। সে অবস্থায় তিনি বেঁচেছিলেন দীর্ঘদিন। ওই অবস্থাতেই তিনি শিকার করেন আরও ১৩টি বাঘ। যে বাঘ একবার নরমাংসের স্বাদ পেতো সে কুকুরের মতো দৌড়ে শিকার ধরতো। এমনটাই জানাচ্ছিলেন ঈমান।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তাকে প্রথম দুই নলা বন্দুক উপহার দেন। সম্মানসূচক খেতাব দেন তাকে। একতার তার ছেলে গওহর আইয়ুব আসেন বাঘ শিকার দেখতে। পচাব্দি একটি শুকর নিয়ে তৈরি করেন টোপ। গাছের উপর করেন বিশেষ মাচা। দুদিন অপেক্ষার পর একটি বাঘ ঠিকই শিকার করে ফেলেন এ শিকারি।

চাচার দুঃসাহসী গল্প শোনাচ্ছেন ঈমান আলী। । ছবি: আসিফ আজিজ
মৌয়াল, বাওয়ালরা বেশি বাঘের আক্রমণের শিকার হতো। একবার কোনো বাঘ সামান্য মানুষের রক্ত-মাংসের স্বাদ পেলে হন্যে হয়ে যায়। তখন তারা আশপাশে অপেক্ষাকৃত এ সহজ শিকার ধরতে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। যেমনটি হতো সেসময়। লোকালয় তো বটেই, খোদ বনবিভাগ মানুষখেকো বাঘ মারার জন্য সবসময় পচাব্দি গাজীকে খবর দিতো।১৯৯৭ সালে মারা যাওয়া পচাব্দি গাজী ১৯৮৬ সালে সবশেষ ৭০ বছর বয়সে বাঘ মারেন। তবে শিকারি এ মানুষটি শুধু বাঘ নয়, মেরেছেন ২০টির বেশি কুমিরও। তার আরও একটি অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল বাঘ, হরিণ, বানরের ডাক নকল করতে পারার ক্ষমতা। যেটা তার শিকারের অন্যতম রহস্য ছিল। বাঘের সঙ্গে বাঘ মেরে অসংখ্য মানুষ, প্রাণীর জীবনের ত্রাণকর্তা পচাব্দি গাজী শুধু বাংলাদেশ নয়, বহির্বিশ্বেও পরিচিত ছিলেন দক্ষ শিকারি হিসেবে।
বনবিভাগের বোটম্যান হিসেবে চাকরি করলেও অভাব তার পিছু ছাড়েনি। সে ছাপ এখনো তার সন্তানদের উপর।
** ওষুধিগুণে চাহিদা বাড়ছে খুলনার চুইঝালের
** ষাটগম্বুজ মসজিদে কত গম্বুজ!
** চিনে খান খুলনার বিখ্যাত চুইঝাল
** ট্যাংরা-পারসের ছটফটানি বাগেরহাট বাজারে (ভিডিও)
** ‘উলুঘ খানের’ ঘোড়া দীঘি টানছে পর্যটক (ভিডিও)
** বাগেরহাটের মিনি কুয়েত!
** পরিযায়ী পাখি যাচ্ছে পর্যটক-ব্যবসায়ীর পেটে
** সুন্দরে এতো হিংসে কেন!
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬
এএ/এসআরএস

সহযোগিতায়