ঢাকা, সোমবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভোটের-কথা

জামায়াত-জাতীয় পার্টির ঘাঁটিতে ‘সিঁধ’ কাটছে আ’লীগ

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৭
জামায়াত-জাতীয় পার্টির ঘাঁটিতে ‘সিঁধ’ কাটছে আ’লীগ সুন্দরগঞ্জ-১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা

সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা: শুধু সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নিয়েই গঠিত গাইবান্ধা-১ আসন। ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার এ আসনটি নানা কারণে বিভিন্ন সময় আলোচিত-সমালোচিত। জামায়াত-জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাইবান্ধা-১।

তবে সবশেষ উপ-নির্বাচনে জামায়াত-জাতীয় পার্টির ঘরে ‘সিঁধ’ কেটেছে আওয়ামী লীগ। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীর কাছে ৮ হাজার ভোটে হারলেও সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনে ৩০ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী।

 

স্বাধীনতার পর এ আসনে প্রায় সবসময় তৃতীয় অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগ সবশেষ উপজেলা নির্বাচনে দ্বিতীয় হয়। আর মার্চে এমপি লিটন হত্যার পর উপ-নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দলটি।  

২০১৩ সালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ও ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর নজিরবিহীন সহিংসতা হয় সুন্দরগঞ্জে। আর এসব সহিংসতায় সরাসরি নেতৃত্ব দেয় জামায়াত। যুক্ত ছিলো বিএনপির নেতাকর্মীরাও। এলাকার সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিবিদদের মতে, এতো সহিংসতা সুন্দরগঞ্জের মানুষ একাত্তর সালেও দেখেনি।

২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি-জামায়াত। সেবার জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে এমপি হন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিজ বাসায় খুন তিনি। লিটন হত্যার অভিযোগে আটক আছেন এই আসনে জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ও লিটনের কাছে হারা প্রার্থী আব্দুল কাদের খান। ২২ মার্চের উপ-নির্বাচনে ৯০ হাজার ভোট পেয়ে ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে হারান আওয়ামী লীগের গোলাম মোস্তফা আহমেদ। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

আফরোজা বারীভোটের হিসাবে এ আসনে আওয়ামী লীগের অবস্থান কখনই খুব ভালো ছিলো না। স্বাধীনতার পর ’৭৩ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট শামসুল হক জিতলেও ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু হয় পতন। সে বছর আসনটি যায় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের হাতে। ১৯৮৬ থেকে ’৯১ পর্যন্ত টানা তিনবার এমপি হন জাতীয় পার্টির হাফিজুর রহমান প্রামাণিক।

স্বতন্ত্র প্রার্থী দুবার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও আওয়ামী লীগের অবস্থান চলে যায় তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে। জামায়াত ভোটের দিক থেকে এগিয়ে ছিলো আওয়ামী লীগের চেয়ে। ’৯৬ সালেও জয়ী হন জাতীয় পার্টির ওয়াহেদুজ্জামান। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট হলে ক্ষমতায় আসেন জামায়াত প্রার্থী আবু সালেহ মো. আব্দুল আজিজ মিয়া। ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টি মহাজোটে এলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন পাননি। জোট থেকে জাপার আব্দুল কাদের খান চারদলীয় জোটের জামায়াত প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন।

খুরশিদ স্মৃতিসাধারণ মানুষ সহিংসা, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও চায় না। তারা যে এ আসনে ধীরে ধীরে জামায়াত-বিএনপি এবং সবশেষ লিটন হত্যার পর জাতীয় পার্টির কাছ থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সেটা স্পষ্ট। আর এই সুযোগে ‘সিঁধ’ কেটে তাদের ঘরে জায়গা পাকা-পোক্ত করছে আওয়ামী লীগ।

এ আসনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে হাফ ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও জাতীয় পার্টি থেকে একজন, বিএনপি থেকে তিনজন ও জামায়াত থেকে একজনের নাম জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে।

একক নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে সব দলেরই।  

শিশু সৌরভকে গুলি করে খলনায়ক বনে যাওয়া এমপি লিটন আবার মানুষের সহানুভূতি পান খুন হওয়ার পর। উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান তার বড় বোন শিল্পপতি আফরোজা বারী ও সহধর্মিনী খুরশিদ জাহান স্মৃতি। কিন্তু পারিবারিক দ্বন্দ্ব কিংবা অন্য কোনো কারণে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় ত্যাগী নেতা, টানা ৩৩ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি গোলাম মোস্তফা আহমেদকে। তিনি বর্তমান এমপি।

আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এমপি হওয়ার সাড়ে চার মাসেই আমি জেলার বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, ব্রিজসহ বিভিন্ন কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছি। আমি সাধারণ মানুষের এমপি। সবাই আমার কাছে আসতে পারে। বন্যায় ত্রাণ দেওয়াসহ ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছি। আশা করি দল আমাকেই মনোনয়ন দেবে।

সাজেদুর রহমানমনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী আফরোজা বারী বলেন, লিটন এমপি ছিলো বলে আমি সামনে আসিনি। দলের নেতাকর্মী এলাকাবাসী এখন আমাকে চায়। নেতাকর্মীরা যেহেতু চাইছে তাই সুযোগ পেলে নির্বাচন করতে চাই।  

তবে লিটনের সহধর্মিণী স্মৃতির মুখে ছিলো পারিবারিক দ্বন্দ্বের ছাপ। তিনি বলেন, তৃণমূলের মানুষ আমাকে চায়। লিটনের অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে নিতে, জামায়াতকে কোণঠাসা করতে আমাকেই প্রয়োজন। আমি ওনাকে (আফরোজা বারী) অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। যখন তিনি বুঝবেন তখন ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যাবে।

আওয়ামী লীগ থেকে এই আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দা মাসুদা খাজা, পৌর মেয়র আব্দুল্লাহ আল মামুন,  জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদুল ইসলামসহ আরও দুএকজনের নাম শোনা যাচ্ছে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে।

লিটন হত্যায় জড়িত থাকায় এ আসনে একটু নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ আসনে আধিপত্য ছিলো দলটির। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে ভরাডুবি ও সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে হার- জাতীয় পার্টির উপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়েছে বলেই মনে করেছেন অন্য দলের নেতারা। ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীই জাপার সম্ভাব্য প্রার্থী।

এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির দপ্তর সম্পাদক রাকিব মোহাম্মদ হাদিউল ইসলাম বলেন, জাতীয় পার্টি থেকে ব্যারিস্টার শামীম মনোনয়নের জন্য লড়বেন। একক নির্বাচন হলে আলাদা কথা। জাতীয় পার্টি যদি মহাজোটের সঙ্গে থাকে তাহলে আসনটি আমরা পাবো বলেই আশা রাখি।

মো. জিয়াউর রহমানসুন্দরগঞ্জে অনেকটাই ব্যাকফুটে রয়েছে বিএনপি। কোনো নির্বাচনেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলো না। তবে এবার দল গোছাচ্ছে বলেই জানালেন উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মো. জিয়াউর রহমান। তার কথায় প্রতিটি দল স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেই আভাস পাওয়া গেলো।  

বিএনপি থেকে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী থানা বিএনপির সভাপতি ও হরিপুর ইউনিয়নের তিনবারের চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম। জোট না হলে নিজের মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী বলেই বাংলানিউজকে জানান তিনি।

এছাড়া মনোনয়নের জন্য আরও চেষ্টা চালাচ্ছেন ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম জিন্নাহ।

মো. জিয়াউর রহমান বলেন, দল থেকে প্রার্থী না হলে দল দাঁড়াতে পারে না। জোট হলেও আমরা জোর দাবি জানাবো। আমরা ৫০ হাজার ভোট আশা করছি। এছাড়া ৩০ হাজার নতুন সদস্য সংগ্রহের প্রস্তুতি চলছে। সেটাও হয়ে যাবে বলে আশা করি।

মো. শহীদুল ইসলাম সরকার মঞ্জুসাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে পুলিশ হত্যাসহ নির্বাচনী সহিংসতা ঘটানোর কারণে চাপে রয়েছে জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপি জোট থেকে এমপি নির্বাচিত হন জামায়াতের আব্দুল আজিজ। বর্তমানে তিনি পলাতক। তার অবর্তমানে নির্বাচন করতে পারেন জেলা জামায়াতের সভাপতি মাজেদুর রহমান। তবে জোট না হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে হলেও নির্বাচনে যেতে মরিয়া জামায়াত। এমনটি জানালেন উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মো. শহীদুল ইসলাম সরকার মঞ্জু।

নির্বাচন করলেও যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার আশা খুব করেন না তা তার কথায়ই তা স্পষ্ট। কারণ এ আসনে মোট ভোট ৩ লাখ ৩৩ হাজারের মতো।

আর কোণঠাসা অবস্থা থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। মহাজোট হলে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের ভোট এক হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী। হত্যা মামলায় জড়ানোর কারণে জোট থেকে জাপার প্রার্থী হওয়া একটু কঠিন হবে। সবশেষ দুই নির্বাচনেও এগিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ।  

আরও পড়ুন:
**সেই সুন্দরগঞ্জেই নির্বাচনে মরিয়া জামায়াত
**‘আমাকে স্পেস না দিলে সুন্দরগঞ্জে জামায়াত মাথাচাড়া দেবে’
** 'লাঙলের ফলায় লিটনের রক্ত, সুন্দরগঞ্জবাসী ভোট দেবে না'
** বিএনপি অফিসও এতো জমজমাট!
** ‘মাঠ যাচাই করে মনোনয়ন দিলে আমিই জিতবো’
** রাজশাহী ৫: অসন্তোষ তৃণমূল বিএনপিতে, চান পা-ফাটা নেতা
** মানুষ এতো অমানবিক কেন!
**চটকা জালের মাছ-আলুভাজিতেই দানাপানি
**ওমর ফারুকের ‘বাঁধভাঙা’ কান্না
**এ কেমন জীবন!
**'নিজে না খাইলেও গরুক খিলাইতে হয়'
** পানির তোড়ে ওষুধ বিক্রেতাও খোলা রাস্তায়
**‘আইজ  হামাক খাবার নেই, কাঁঠাল সিদ্ধ কইরে খাব’
**রাস্তায় জ্বলছে চুলা, রাস্তায়ই খাওয়া
** গম-ভুট্টা-পাটক্ষেতের উপর দিয়ে চলছে নৌকা!
** পচা ড্রেনে ছিপ ফেলে কেজি কেজি মাছ!
** নির্বাচনী এলাকায় ‘তুলোধুনো’ এমপি দারা!
** তিতুমীরে হিজড়া-ভিক্ষুকের রাজত্ব!
** পেরেছে কলকাতা-রাজশাহী, পারলো না শুধু ঢাকা!
** ‘নির্বাচিত হলে গ্রামেও আনবো ডিজিটাল সুবিধা’
** এমপি হলে পুরো বেতন অসচ্ছল নেতাকর্মীদের দেব
** ভরসন্ধ্যায় নির্বাচনী উত্তাপ রাজশাহী মহানগর আ'লীগ অফিসে

** এই আমাদের বিমানবন্দর রেলস্টেশন!

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৭
এএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।