ঢাকা, রবিবার, ১ চৈত্র ১৪৩১, ১৬ মার্চ ২০২৫, ১৫ রমজান ১৪৪৬

অন্যান্য

এক অজানা ভয় মিডিয়ার গতি রোধ করছে

মতিউর রহমান চৌধুরী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫
এক অজানা ভয় মিডিয়ার গতি রোধ করছে

অস্থিরতা চারদিকে। রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সর্বত্র একই অবস্থা।

আমরা জানি, যেখানে ন্যায়বিচার, সেখানেই জয়। কিন্তু, দেশে ন্যায়বিচার প্রায় অনুপস্থিত। আগে ছিল টেলিফোন জাস্টিস। এখন কাবু করছে মব জাস্টিস। মিডিয়া এর বাইরে নয়। আমরা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সেলফ সেন্সরশিপ ঘিরে ধরেছে। আটকে দিচ্ছে মিডিয়ার স্বাভাবিক গতি। তাই মিডিয়া নীরব, মাঝে-মধ্যে সরব হওয়ার চেষ্টা। কখনো কখনো উদ্দেশ্য খুঁজে গতি রোধ করা হচ্ছে।

সেলফ সেন্সরশিপ এক ধরনের কালচারে পরিণত হয়েছে। এখন কেউ হয়তো এসে বলে না, কিংবা ফোন করে না- কোন খবর যাবে, কোনটা যাবে না। আমরা নিজ থেকেই সিদ্ধান্ত নিই, কাউকে কিছু বলি না। খোলাসা করে বলা কঠিন। লেখা তো আরও ঝুঁকিপূর্ণ। অদৃশ্য শক্তি নয়, প্রকাশ্যেই এসব ঘটছে। কেউ প্রতিবাদ করে না। নীরবে মেনে নেয়। প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ায় না। বলে না- আমার প্রতি অবিচার হয়েছে। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠনগুলো নিশ্চুপ। একদা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ছিল এটাই মানুষ ভুলে গেছে। বিশেষ করে মিডিয়াকর্মীরা। অনেক সাংবাদিক চাকরি হারিয়ে নিঃস্ব। কারও কাছে অভিযোগ জানানোর সুযোগও নেই। আন্তর্জাতিক দু-একটা প্রতিষ্ঠান মাঝে-মধ্যে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এটাইবা কম কীসের! আগে প্রাপ্তির কাছে আমরা নিজেদের সঁপে দিয়েছিলাম। নেমেছিলাম এক ধরনের প্রতিযোগিতায়। এখন এক অজানা ভয় পেছনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।

টকশোতেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস নিয়ে নতুন এক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। দলীয় কর্মীরা যেভাবে দৌড়াচ্ছেন, ঠিক সেভাবে বিপুলসংখ্যক মিডিয়াকর্মীও চলে গেছেন আত্মগোপনে। অনেকে আবার জেলখানায়। কেউ কেউ বিদেশে। এর মধ্যে কারও কারও সাংবাদিকদের বিবেকের ওপর চাপ না বাড়লে কোনো দিনই পরিস্থিতি পাল্টাবে না ব্যাংক হিসাব চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এতে মানুষ বিরক্ত। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সাংবাদিকদের ওপর থেকে। একদিকে বিভাজন, অন্যদিকে অজানা ভয় কাবু করে ফেলেছে গোটা মিডিয়াকে। প্রিন্ট বলুন বা ইলেকট্রনিক বলুন, সবখানেই একই অবস্থা। এ পরিস্থিতি হঠাৎ করে হয়নি। অনেক দিন থেকেই আমরা এর সঙ্গে বসবাস করছি। স্বাধীনতার পরপর আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম।

সামরিক জমানায় ছিলাম নির্বাক। এরপর এলো নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। সেখানেও কমবেশি নিয়ন্ত্রণ। হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনে আমরা মিডিয়ার পরিচয় ভুলে গিয়েছিলাম। জনগণকে সাক্ষী রেখেই আমরা নিজেদের আত্মপরিচয় বিলুপ্ত করেছিলাম। এতে দেশবাসী লজ্জা পেলেও আমরা পাইনি। এখন এজন্য আমাদের কড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। তাদের কারণেই মিডিয়া আজ অনেকটা অস্তিত্ব সংকটে। এখন সত্য খবরের পেছনে কেউ ছোটে না। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিদায় নিতে চলেছে। অনেকেই এর পেছনে উদ্দেশ্য খোঁজেন। লাগিয়ে দেন ‘ট্যাগ’। এ কারণে খবরের পেছনের খবর খুঁজে বের করতে কেউ সাহসী হন না। মিডিয়া হাউসগুলো সময়ের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে, অনেকটা অযৌক্তিকভাবে। ডিজিটাল, সাইবারসহ নানা আইনি-বেআইনি বেড়াজাল মিডিয়ার গতি রোধ করছে। এ পরিস্থিতির উন্নতি কি সম্ভব? কেউ কেউ বলেন, অবশ্যই সম্ভব। রাজনীতিবিদদের শুভ বুদ্ধির উদয় হলে রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টাবে। তবে কেন যেন মনে হয়, সাংবাদিকদের বিবেকের ওপর চাপ না বাড়লে কোনোদিনই পরিস্থিতি পাল্টাবে না। মানুষ ভুল করে, ইতিহাস নয় কিন্তু। আমাদের রাজনীতিবিদরা যেভাবে সবকিছু ভুলে যান, ঠিক তেমনিভাবে আমরা সাংবাদিকরাও। ৫৩ বছরের সাংবাদিকতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমনটাই দেখা যায়। স্বাধীন দেশের সাংবাদিকতা এখানে বরাবরই অনুপস্থিত। এজন্য আমি রাজনীতিবিদদের এককভাবে দায়ী করি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছি। অন্যের কণ্ঠ রোধ করার খবরে হাততালি দিয়েছি। বিশেষ বিশেষ জায়গায় গিয়ে বলেছি, যা করেছেন ঠিক করেছেন।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন

বাংলাদেশ সময়: ১১১৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।