ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২, ১৩ মে ২০২৫, ১৫ জিলকদ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

দস্যুদের মোবাইলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

পানিশমেন্ট সেন্টার আওয়ামী লীগ অফিস!

রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:১৪, মার্চ ২২, ২০১২
পানিশমেন্ট সেন্টার আওয়ামী লীগ অফিস!

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। প্রকৃতির খেয়ালের ওপর ভর করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা।

তার ওপর জলে-স্থলে দস্যুদের অতর্কিত হানা এখানকার মানুষকে রাখে চরম অনিরাপত্তায়। পুরোটাই এক সন্ত্রাসের উপকূল। এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এক পক্ষকাল চষে বেড়িয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ ও ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধর। তুলে এনেছেন সন্ত্রাসের ওই জনপদের অনেক সচিত্র কাহিনী। আজ এর শেষ কিস্তি ...

সন্দ্বীপ-হাতিয়া এলাকার কুখ্যাত জলদস্যু সম্রাট নিজাম ডাকাত যে দুটি মোবাইল ফোনসেট ব্যবহার করেন, তার প্রতিটিতেই ওয়েলকাম টিউন হিসেবে তিনি ব্যবহার করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব‍ুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।

কেবল নিজাম ডাকাত নয়, বাহার কেরানি, কামাল উদ্দিন, করিম ফিটার, ইব্রাহীম ব্যাপারী, নূরু মেম্বারসহ প্রায় সবার মোবাইলের ওয়েলকাম টিউনই বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ।

জলদস্যুরা চর এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যারিংচর, চর বাসার, নলের চর, বয়ার চর, জাহাইজ্জার চর, উড়িরচরসহ তাদের সাম্রাজ্য ভাগ করেছে ৪৫টি ইউনিটে। এসব এলাকায় তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে একটি করে বাজার। আর বাজারের নাম দিয়েছে আওয়ামী লীগের বর্তমান কিংবা প্রয়াত নেতা, নিজের বা নিজের সন্তান এবং শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের নামে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চর বাসারের নাম করা হয়েছে এক সময়ের জলদস্যু সম্রাট বাসার মাঝির নামে। ক্যারিং চরে বাসার মাঝির মেয়ের নামে আছে শাবনাজ বাজার। এই চরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে আছে মুজিব বাজার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে আছে হাসিনা বাজার। বঙ্গবন্ধুর অপর মেয়ে শেখ রেহানার নামে আছে রেহানা বাজার। শেখ রাসেলের নামে রাসেল বাজার, শেখ কামালের নামে কামাল বাজার, শেখ জামালের নামে জামাল বাজার। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে আছে জয় বাজার ইত্যাদি। আছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীনের নামে ফখরুদ্দীন বাজার।

ক্যারিংচরে প্রয়াত বাসার মাঝির সদর দফতর মুজিব বাজারে। নিজাম ডাকাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানি এবং মুজিব বাজার সেক্টরের কমান্ডার করিম ফিটার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা এ এলাকাকে একটি স্বতন্ত্র উপজেলা হিসেবে ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি করছি। নতুন এ উপজেলার নাম হবে মুজিব নগর উপজেলা। ’

নিজাম ডাকাত এলাকার নামকরণ সব আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে রাখা সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা সবাই আওয়ামী লীগ করি। বাসার মাঝি বেঁচে থাকতেই তিনি এসব নামকরণ করে গেছেন। এ কারণে চারদলীয় শাসন আমলে এমপি আজিম সাব আমাদের অনেক অত্যাচার করেছেন। ’

প্রশাসনের মধ্যে আরেক প্রশাসনcarring-chor
বাজারগুলোতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বাজারেই নিজাম বাহিনীর একটি করে ‘পানিশমেন্ট সেন্টার’ (শাস্তি কেন্দ্র) আছে। কেন্দ্রগুলো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর পোস্টারে সাজানো। এসব সেন্টারকে তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের অফিস হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তবে কোথাও এসব সংগঠনের সাইনবোর্ড নেই। প্রতিটি অফিসকে কেন্দ্র করে আছে দস্যুদের দু’টি করে কমিটি। এলাকার বাহিনী কমান্ডারই এসব অফিসের সভাপতি এবং তার সহকারী সাধারণ সম্পাদক।

প্রতিটি অফিসেই আছে বাঁশে লাগানো মাইক। ভূমিহীনদের ধরে এনে এসব মাইকে বিচার কার্যক্রম প্রচার করা হয়। এদেরই কয়েকজন গোপনে বাংলানিউজকে জানান, মাসিক চাঁদা, মৌসুমী ধান ও বার্ষিক টাকা না দিলে ভূমিহীনদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়। এ ছাড়া সাংবাদিক বা প্রশাসন কিংবা পুলিশের সঙ্গে কথা বললে নিজাম বাহিনীর ইউনিট কমান্ডার তার বাহিনীর মাধ্যমে ধরে নিয়ে আসে অভিযুক্ত ভূমিহীনদের। এরপর ওই এলাকার সবাইকে মাইকের মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হয় পানিশমেন্ট সেন্টারে আসার জন্য। সবার সামনে বিচার করেন কমান্ডার। শাস্তি হিসেবে লাঠি দিয়ে আমানবিকভাবে পেটানো হয় অভিযুক্তকে। এ কার্যক্রম মাইকের মাধ্যমে শোনানো হয় বাড়িতে থাকা নারীদেরও। মৃত বাসার মাঝি চালু করে গেছেন এই বিচার প্রক্রিয়া।

উপজেলা কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান বলেন, ‘চর জেগে ওঠার আগেই জলদস্যুরা এসব চরের দখল নিয়ে নেয়। আমি শুনেছি এরা ইউনিটভিত্তিক জমি ভাগ করে ভূমিহীনদের জায়গা দেওয়ার নামে ভূমিহীনদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করে। এরা জমি বরাদ্দের সময় চালাকি করে এলাকার নাম রাখে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের নামে। প্রতিটি এলাকায় বাজার, পুলিশ ফাঁড়ি, স্কুলের জন্য জায়গা রাখে। ’

ডাকাতদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে কেউ প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ করে না। হাতিয়া থেকে এক একটি চরে যেতে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার মেঘনা পাড়ি দিতে হয়। তাছাড়া চরের কেউই কারো বিরুদ্ধে মুখ খোলে না অত্যাচরের ভয়ে। প্রশাসন চলে এলেই তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে নতুন একজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেখানে বাস করতে দেওয়া হয়। সে কথা না শুনলে তাকেও উচ্ছেদ করে অন্য কাউকে ...। এভাবেই চলে চরের জীবন। ’

তিনি বলেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় প্রশাসনের পক্ষেও চরবাসীকে সাহায্য ও নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। ’

চরে শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে গেছেন মৃত বাসার মাঝি। নিজাম বাহিনীর প্রধান নিজাম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের মুরুব্বী এই চরে ৪৫টি স্কুল, ৪৫টি মাদ্রাসা, ৪৫টি মসজিদ, ৪৫টি পার্টি অফিস ও ১টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি জীবিত থাকার সময় নিজ খরচে এসব প্রতিষ্ঠান চালাতেন। এখন আমি এগুলো দেখাশোনা করি। ’

নিজাম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানি বলেন, ‘আমরা চরের ভূমিহীনরা এ সব প্রতিষ্ঠান চালাই। এজন্য পরিবারপ্রতি মাসে ৫০/১০০ টাকা নেওয়া হয়। চৌধুরী সাব (নিজাম) আমাদের প্রতিটি মাদ্রাসায় ৪টি করে মাইক, একটি করে সোলার প্যানেল দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিটি স্কুলের ২ জন করে মাস্টারের বেতন ৫ হাজার করে এবং মাদ্রাসায় একজন বাংলা মৌলানা এবং একজন আরবী মৌলানার বেতন দিতে হয় ৭ হাজার করে। ’

তিনি বলেন, ‘গরমের দিন এলেই চরে মহামারী আকারে ডায়রিয়া শুরু হবে। তখন স্কুল বন্ধ করে এখানে হাসপাতাল বানানো হবে। নিজাম চৌধুরী নিজ টাকায় এ হাসপাতাল চালাবেন। ’

এইসব মাদ্রাসা ও মসজিদে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজাম ডাকাতের জন্য দোয়া কামনা করে মিলাদ ও দোয়া পাঠ করা হয় বলে জানালেন মুজিব বাজার মাদ্রাসার ছাত্র আল-আমিন। ডাকাতের জন্য দোয়া করেন কেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিজাম চৌধুরী আমাদের মাঝে মাঝে মহিষ জবাই করে খাওয়ায়, তাছাড়া আমাদের হুজুর মিলাদ পড়ায়, আমরা পড়ি। ’

চরে চলাচলের জন্য কোনো রাস্তা নেই। দস্যুরা নিজেদের চলাচলের জন্য একটি পায়ে হাঁটা রাস্তা বানালেও বর্ষা মৌসুমে তা থাকে পানির নিচে। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে দেখা গেল নিজের পা-ই এখানকার একমাত্র যান। কয়েকটি বাজারে একটি করে নলকূপ থাকলেও এ ব্যবস্থা নেই কোনো বাড়িতে। কাঁচা কূপই এখনকার আড়াই লাখ মানুষের একমাত্র পানির ব্যবস্থা। তাও সব বাড়িতে নেই। খোলা আকাশের নিচের দূষিত পানি খেয়ে সারা বছরই কলেরা আমাশয়ের মতো মহামারীতে ভোগেন চরের সাধারণ ভূমিহীনরা।

হাতিয়া উপজেলা কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান বলেন, ‘চরে আমাদের দু’টি প্রশাসনিক কমিটি আছে। এদের মাধ্যমে এসব স্কুলে সরকারের তরফ থেকে বই সরবরাহ করা হয়। ’

তিনি বলেন, ‘এ বছর হাতিয়া উপজেলায় ১৮টি নলকূপ এসেছে। এ দিয়ে কয়জনের কাজ হবে!’

চরে সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে
চরে সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখানে সরকারের দু’টি প্রশাসনিক কমিটি আছে, তা দিয়েই কাজ চলছে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ থাকলেও দীর্ঘ দিন ধরে এখানে নির্বাচন হচ্ছে না। ’

তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের আইন অনুযায়ী এতদিন নির্বাচন না দিয়ে প্রশাসক দিয়ে স্থানীয় সরকার চালানো অসাংবিধানিক। ’

এ বিষয়ে উপজেলা কর্মকর্তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত নোট পাঠিয়েছেন বলেও জানান।

চরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা, ছিনতাই, নৌ-ডাকাতি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ছাড়াও চরের সমগ্র অর্থনীতির দখল জলদস্যুদের হাতে। চরের ৪৫টি ছোট ছোট বাজারের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক জলদস্যুরা। এ ছাড়া মাছ ঘাট, জেলে নৌকা, দাদন ও মাছের ব্যবসা জলদস্যু এবং তাদের মদদদাতাদের দখলে।

স্থানীয় ভূমিহীনরা জানান, কেবল তাই নয়, বর্ষা মৌসুমে ভূমিহীনরা মাছ ও কাঁকড়া ধরেন। যা জলদস্যুর এজেন্টদের কাছে পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা। এ ছাড়া প্রতিটি পরিবারকে প্রতি মৌসুমে দাগ প্রতি (১৬০ শতাংশ) ৫ মণ ধান দিতে হয়। গরু বা মহিষ প্রতি দিতে হয় ৩০০ টাকা (মাসে)। এর অন্যথা হলে পানিশমেন্ট সেন্টারে চলে নির্যাতন।

বাংলাদেশ সময় : ১৪৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১২

আরএম/এআর
সম্পাদনা : আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।