ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

রেডিও ধারাভাষ্যের একাল-সেকাল

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২২
রেডিও ধারাভাষ্যের একাল-সেকাল মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রেডিও ধারাভাষ্য কক্ষ। ছবি : শোয়েব মিথুন

চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে। মুখে বয়সের ছাপও স্পষ্ট।

চোখে হালকা রঙিন সানগ্লাস। স্বভাবে চঞ্চলতা একটুও কমেনি এখনও। ভদ্রলোককে এটুকু বর্ণনায় আপনার না চেনারই কথা। তবে নাম শুনলে হয়তো খুঁজে পাবেন স্মৃতিতে- আলফাজউদ্দিন আহমেদ। এখনও চিনলেন না?

তাহলে আপনাকে চেনানোর উপায় একটাই- তার কণ্ঠ। খেলা নিয়মিত দেখে থাকলে, বয়স কোনোরকমে বিশ পেরোনো হলেও ‘আমি আলফাজউদ্দিন আহমেদ আছি ধারাভাষ্যকক্ষে...’ কথাটা বহুবার শোনার কথা আপনার।  

বিদ্যুৎ বিভ্রাটের দিনগুলোতে রেডিও হাতে নিয়ে বন্ধুদের মিলনমেলার স্মৃতি বেশির ভাগের চোখেই হয়তো রঙিন। সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে অনেককিছু। রেডিওর যুগ পেরিয়ে টিভি, এখন হাতে হাতে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটও।

এসবকিছুরই সাক্ষী আলফাজউদ্দিন আহমেদ। রেডিও ধারাভাষ্যের একাল-সেকালের গল্প বলতে তার চেয়ে ভালো কাউকে খুঁজে পাওয়া ভীষণ মুশকিল এখন। বয়স ৭২ হয়ে গেছে। ব্যাংকে চাকরি করে অবসরে চলে গেছেন। ধারাভাষ্য দিচ্ছেন প্রায় ৪২ বছর ধরে। এখনও আগের মতো উদ্যমী হয়েই মিরপুরের ধারাভাষ্য কক্ষে হাজির হন।

আলফাজউদ্দিন আহমেদ

তিন ভাই একসঙ্গে ভলিবল দলে খেলেছেন। সেখানে দেখা পান আব্দুল হামিদের। তার সঙ্গে ধারাভাষ্য দেওয়ার ইচ্ছে থেকেই অডিশন দেন বাংলাদেশ বেতারে, একবারেই টিকেও যান। এরপর হামিদুর রহমান ও তোফিক আজিজ খানের মাঝে বসে ধারাভাষ্য দেওয়ার শুরু। এরপর কেটে গেছে চার দশক।

ওই অভিজ্ঞতা থেকেই আলফাজউদ্দিন শোনাচ্ছিলেন কীভাবে বদলে গেছে রেডিও ধারাভাষ্য, ‘অনেক কিছুই বদলে গেছে এখন। একদম শুরুর দিকে, আমার বন্ধু ছিল খোদা বক্স মৃধা- কোনো বিদেশি দল আসলে ম্যাচের আগের দিন আমরা ওদের হোটেলে যেতাম। ওই দলের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে খেলোয়াড়দের জীবন বৃত্তান্ত জানতাম। ডায়েরিতে লিখে রাখতাম । কত ম্যাচ খেলছে, কী করেছে, কার দিকে চোখ রাখা যায়; এসব। ’

‘ক্রিকেট ধারাভাষ্য যখন শুরু হলো, নব্বই দশকের কথাই বলি- ধারাভাষ্য কক্ষে দুজন ধারাভাষ্যকারের মাঝখানে একজন স্কোরার বসতো। লাল কালিতে ছক্কা লিখতো, সবুজ কালিতে চার, এক-দুই লিখতো কালো কালিতে, কত বলে কত রান করলো এসব হিসাব করে রাখতো। তারপর আমাদের দিতো। ’

স্মৃতিতে সেসব স্বর্ণালী সময়ের সঙ্গে রঙিন দুনিয়ার ঝকঝকানি দেখছেন এখন। সময়ের ব্যবধানে বদলে যাওয়া বাস্তবতা আলফাজ বলছিলেন বাংলাদেশ-ভারত সিরিজের ব্যস্ততার ফাঁকে, ‘একটা সময় টিভি মনিটরের আমাদের রুমের ভেতর চলে এলো। এখন তো আরও সহজ হয়ে গেছে সবকিছু। স্ট্যাটগুরুতে সার্চ দিলেই চলে আসে। ধারাভাষ্য কক্ষে ওয়াইফাই আছে। আমরা সার্চ করে দেখি কে কী করলো। আগে এসব পেছন থেকে বলে দিতে হতো...’

বাংলা ধারাভাষ্যের শুরু হয় মূলত ৬০ এর দশকে অজয় বাবু, কমল বোসদের হাত ধরে। কলকাতা থেকে এই অঞ্চলে পরে নিয়ে আসেন হামিদুর রহমান, তৌফিক আজিজ খানরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বেতারে ধারাভাষ্য শুরু হয়। তারকা হয়ে উঠেন আব্দুল হামিদ, তৌফিক আজিজ, মনজুর আহসান মিন্টুরা।

আলফাজ আহমেদদের আগমন আরও পরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বন্ধু খোদা বক্স মৃধা, মোহাম্মদ মূসাসহ অগ্রজ-অনুজদের সঙ্গে নিয়ে পথে চলেছে আলফাজ আহমেদের। কীভাবে উন্নতি করা যায়, এসব নিয়ে ভেবেছেন একসঙ্গে। জীবনে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাও সঙ্গী হয়েছে। মুখ ছাপিয়ে মানুষের কাছে ছড়িয়ে গেছে কণ্ঠ।

তেমনই এক গল্প বলছিলেন আলফাজউদ্দিন, ‘ একবার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে যাচ্ছি। বেনাপোলে তো খুব ভিড় হয় বর্ডারে, ওখানে অনেক দালালও থাকে। আমি নামার সঙ্গে সঙ্গেই বললো টাকা আর পাসপোর্ট দেন। আমি সবকিছু করে দিচ্ছি। তখন বললাম, আমি তো পড়ালেখা জানি, নিজের কাজটা নিজেই করতে পারবো!’
  
‘কিন্তু টাকা ছাড়া ওখানে কাজ হয় না। পুলিশের রুমে পাসপোর্টে টাকা ঢুকিয়ে গেলাম। গিয়ে পাসপোর্ট দিলাম। পাতা উল্টে উনি নাম দেখলেন আলফাজ উদ্দিন আহমেদ। ভদ্রলোক বললেন আপনি কোন আলফাজ উদ্দিন আহমেদ? আমি আস্তে আস্তে বললাম ভাই, আমি আসলে একটু খেলাধুলার ধারাভাষ্য দেই...’

উচ্ছ্বাস নিয়ে বাকি গল্প বলেন কিংবদন্তি ধারাভাষ্যকার, ‘এ কথা বলতেই উনি লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। জড়িয়ে ধরলেন। বললো, ভাই আপনি বসেন। আমি বললাম তাড়া আছে..উনি কিছুতেই ছাড়বেন না। নিজে কাস্টমসে নিয়ে গিয়ে হৈচৈ করলেন, বললেন এই দেখো আলফাজ ভাই। বর্ডার অবধি পার করে দিলেন। এরকম ঘটনা অহরহ আছে। হয়তো চেহারায় অনেকে চেনে না। কিন্তু কণ্ঠ শুনলেই ধরতে পারে...’

কণ্ঠ শুনে এমন চেনার দিন কি ফুরিয়ে গেছে? আলফাজউদ্দিন মনে করেন না তেমন। হাতে হাতে স্মার্টফোন। ফোনে ফোনে ইন্টারনেটের রঙিন দুনিয়ার হাতছানি। সরাসরি টেলিভেশনে খেলা দেখার সুযোগ, আগে-পরে বিশ্লেষণও অনেক। তবুও রেডিও ধারাভাষ্যের আবেদন আলাদা বলে মনে করেন আলফাজ।

‘আবেদন কমে গেছে বলে আমি মনে করি না। হয়তো আধুনিক যুগে শহর কেন্দ্রিক ছেলেরা এরকম ভাবে। কিন্তু গ্রামে গেলে এখনও দেখবেন রেডিওতেই খেলা শুনছে বেশি লোক। রেডিও ধারাভাষ্যের যে আমেজ...এখনকার ছেলেরা হয়তো দেখেনি। কিন্তু এক সময় আমরা রেডিও শোনার জন্য একজনের বাড়িতে যেতাম। গেলে বসতে দিতো, ১৫-২০ জন মিলে শোনতাম, আনন্দে জড়িয়ে ধরতাম, লাফাতাম...’

‘এখন তো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে সবকিছু। একাই শোনা যায়। এই পরিবর্তন এসেছে সত্যি। তবে এখনও গ্রামে গেলে দেখবেন চায়ের দোকানে জোরে জোরে রেডিওর ধারাভাষ্য শুনছে। চা খেতে খেতে লোকজন চিৎকার করছে, তর্ক করছে। এমনকি এখনও রাস্তায় আপনি বের হলে দেখবেন রিকশাওয়ালার কানে হেডফোন, রেডিও ধারাভাষ্য শুনছে...’

১৯৮১ সালের শীতের এক সকালে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে ধারাভাষ্য দিয়ে শুরু। এরপর বহু বাঁক বদলের সাক্ষী হয়েছেন আলফাজ আহমেদ। ভাই আহমেদ শরীফ অভিনয়ে নাম কুড়িয়েছেন, তিনি কণ্ঠের জাদুতে। পুরো যাত্রাটা আসলে কেমন ছিল? প্রশ্ন শুনে গুণী মানুষ জবাব দেন, ‘জীবনের মতো...’। ভাঙা রেডিও যদি ফুরিয়েও যায়, আলফাজউদ্দিন আহমেদরা নিশ্চয়ই বেঁচে থাকবেন বাতাসে ভেসে বেড়ানো কণ্ঠে। ‘ধন্যবাদ ধারাভাষ্যকার...’ কেউ না বললেও।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২২
এমএইচবি/আরইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।