ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

পর্যটকের উচ্ছিষ্ট খাবারে অভ্যস্ত লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণী

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২০
পর্যটকের উচ্ছিষ্ট খাবারে অভ্যস্ত লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণী

মৌলভীবাজার: গাছের প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি এখন কৃত্রিম খাবারের দিকে অগ্রসর হয়ে পড়েছে লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণীরা। গাছে ঝুলে থাকা খাদ্য ছাড়াও তাদের আগ্রহ এখন মাটিতে ফেলে দেয়া খাবারগুলোর প্রতি। এর ফলে জীববৈচিত্র্যের খাদ্যশৃঙ্খল হচ্ছে বাঁধাগ্রস্ত। বাড়ছে বন্যপ্রাণীকে ঘিরে মানুষের মাঝে ছোঁয়াচে বা সংক্রামক ব্যাধির শঙ্কা।

দৈনিক সীমাহীন পর্যটকের পদভারে মুখর হয়ে গেছে সংরক্ষিত বন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। পর্যটকদের ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট কৃত্রিম খাবারে আসক্ত হয়ে পড়ছে এক শ্রেণির বন্যপ্রাণীরা।

এই খাবারের টানেই তারা আসে। কেউ একা, আবার কেউ দলগতভাবে। মনের আনন্দে খেয়ে যায়। তাতে করে তারা বনের প্রাকৃতিক খাবারের দিকে না গিয়ে একেবারে সহজে পাওয়া খাবারের দিকেই অগ্রসর এবং নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বেশি।

একটি সংরক্ষিত চিরসবুজ বনে প্রতিদিন শত শত পর্যটক ভেতরে প্রবেশ করছেন। ফলে বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আবাসস্থল বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংকট থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- বন্যপ্রাণীদের স্বার্থে লাউয়াছড়ায় পর্যটক সীমিতকরণ করার কথা।

সম্প্রতি লাউয়াছড়ায় জাতীয় উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, একটি সিংহ বানর (Northern Pig-tailed Macaque) পর্যটকদের ফেলে দেয়া ডাবের পরিত্যক্ত অংশটি হাতে ধরে নিয়ে ডাবের ভেতরের তুলতুলে নরম অংশটি খেতে ব্যস্ত। শুধু বানরই নয়, বুনো শুকরেরাও (Eurasian Wild Boar) সদলবলে পর্যটকের উচ্ছিষ্ট খাবারের খোঁজে হানা দেয়।

এছাড়াও ‘মুন্নি’ নামের একটি দলছুট কোটা বানর (Rhesus Macaque) আরো কয়েকটি কোটা বানর মানুষের সংস্পর্শে থেকে থেকে প্রায় ‘গৃহপালিত’ হয়ে গেছে। ওরা আর বনের গাছে গাছে বিচরণকরা বানরদের সাথে মিশতে পারছে না। স্থানীয় মানুষসহ ট্যুরিস্টরা যা খাবার দিচ্ছে তা-ই মনের আনন্দে খেয়ে নিচ্ছে।  

গাছের বানর মাটির ফেলে দেয়া খাবারেই খুশি।  ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

লাউয়াছড়া বিটের বিট কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, প্রায়ই লাউয়াছড়ার গেইট সংলগ্ন আশেপাশে সন্ধ্যার সাথে সাথে বনোশুকরের দল নেমে আসে। পর্যটকেরা সারাদিন যে খাবার খেয়ে অবশিষ্ট অংশগুলো ফেলে দেয়, ওরা এসে এগুলোতে ভাগ বসায়।

শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব বলেন, লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণীরা মারাত্মকভাবে খাদ্য সংকটে ভুগছে। তাই খাবারের খোঁজে লাউয়াছড়া থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে এসে মানুষের হাতে ধরা পড়ছে। কোনোটা আবার গাড়ির চাকায় প্রাণ হারাচ্ছে। পরবর্তীতে খবর পেয়ে আমরা গিয়ে উদ্ধার করি, প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসার পর প্রাণীটিকে বনে অবমুক্ত করি।  

গত ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন নানা প্রজাতির প্রায় ৩৭৬টি বন্যপ্রাণী লাউয়াছড়াসহ সিলেট বিভাগের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করেছে বলে জানান সজল।

সংরক্ষিত বনে দৈনিক ভ্রমণকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বানরসহ অন্যান্য প্রাণীদের জন্য হুমকি কি না – এমন প্রশ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)-এর প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও লেখক ড. কামরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, মানুষের সংখ্যা বাড়ার ফলে এই বানরগুলো সব সময় অপরচুনিস্টিক (সুযোগসন্ধানী)। দেখা যায়, ইজিফুড (সহজলভ্য খাবার) যদি পায় তাহলে সেখানে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়। যেমন ধরেন, ট্যুরিস্টদের (পর্যটক) কেউ ডাব খেয়ে ফেলে রাখছে। তারা এসে সহজে প্রতিদিন যদি ওই ডাবগুলো পায় তাহলে তারা ওই খাবারটির উপর অভ্যস্ত হয়ে যাবে।  

রোগজীবাণু’র কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক পর্যটনকেন্দ্রের সামনে অনেক সময় পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইচ্ছে করেই বন্যপ্রাণীদের খাবার দেয়া হয়। যেমন- বানর বা এ জাতীয় প্রাণী যেন সবসময় এখানে থাকে, যাতে ট্যুরিস্টরা এসে দেখবে। কিন্তু এর ফলে মূলত দুটি সমস্যা হবে। প্রথমটি হলো বানরটিও সহজলভ্য বা কৃত্রিম খাবারটির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে যাবে; দ্বিতীয়টি হলো- একই সাথে মানুষের সাথে তাদের সংস্পর্শতা বাড়বে এবং তাতে করে রোগজীবাণু ছড়ানোর সুযোগও তত বাড়বে। যেটা বানরের জন্যও ক্ষতি; মানুষের জন্যও ক্ষতি।

প্রফেসর ড. কামরুল বলেন, এরজন্য ট্যুরিস্ট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা বলছি না যে, লাউয়াছড়াসহ সংরক্ষিত বনগুলোতে ট্যুরিস্ট আসবে না। কিন্তু ট্যুরিস্ট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। লাউয়াছড়ার ট্যুরিস্ট এখন আনকন্ট্রোলড ওয়েতে (অনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি) চলে গেছে। দৈনিক যত খুশি তত ট্যুরিস্ট যাচ্ছে। এটি যেকোনো ভাবেই হোক কন্ট্রোল করতে হবে যে, নির্দিষ্ট পরিমাণের অতিরিক্ত ট্যুরিস্ট অ্যলাউ (গ্রহণ) করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, একটি চিরসবুজ বনের ভেতর দিয়ে যত ট্যুরিস্ট যায়, তারা যে যেখান দিয়ে পারে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তার ফলে যেটা হয় সেটা হলো বন্যপ্রাণীদের ডিসটার্বেন্স (বিরক্তি) অনেক বেশি হয়। যেমন- এরা ঠিক মতো খাবার খেতে পারে না। ছোটগাছ নষ্ট হচ্ছে, ফলের গাছ নষ্ট হচ্ছে। এ সবকিছুই ট্যুরিস্টের কারণে।

‘বনের বন্যপ্রাণীদের কথা বিবেচনায় রেখে বনের ভেতরের যদি একটিও ফলের গাছ থাকে তাহলে সেই ফলের গাছটিকে সুরক্ষিতভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে; নয়তো বন্যপ্রাণীরা খাবে কি?’ বলেন জাবি’র এই বন্যপ্রাণী গবেষক।

বাংলাদেশ সময়: ০৬১৫ ঘন্টা, মার্চ ০৩, ২০২০
বিবিবি/এমকেআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।