বাংলাদেশের জার্সিতে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা একজন ফুটবলার খেলবেন, এমনটা একসময় কল্পনার দূরত্বে ছিল। তবে সেই কপনার দূরত্ব কমে আসে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংলিশ ফুটবলার হামজা চৌধুরীর কারণে।
বাংলাদেশ সময় গতকাল রাত দু’টায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটর উদ্দেশে রওনা হন হামজা। এ সফরে তার সঙ্গী মা, স্ত্রী ও সন্তানেরা। আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সরাসরি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সপরিবারে নামেন হামজা। বিমানবন্দরে তাকে একনজর দেখার জন্য ভক্ত-সমর্থক ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের উপচেপড়া ভিড় বলে দেয়, কতটা কাঙ্ক্ষিত ছিলেন ২৭ বছর বয়সী এই ফুটবলার।
হামজাকে দেখার পরপরই ভক্তদের 'ওয়েলকাম টু মাদারল্যান্ড হামজা, হামজা' স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে এয়ারপোর্ট প্রাঙ্গণ। লাল-সবুজ ফ্লেয়ার স্মোক উড়িয়ে এই তারকা ফুটবলারকে বরণ করে নেয় সমর্থকরা। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাকে নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। দেশের ফুটবলে দিনবদলের শুরুটা কি তাহলে হামজাকে দিয়ে হচ্ছে? সেটি দেখার জন্য খুব বেশি অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।
বিমানবন্দর থেকে সরাসরি হবিগঞ্জের বাহুবল থানার স্নানঘাট গ্রামে চলে যাবেন হামজা। সেখানে আজ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবেন তিনি। এরপর আগামীকাল রাত ৮টা ৪০ মিনিটের ফ্লাইটে ঢাকায় গিয়ে বাফুফের ক্যাম্পে যোগ দেবেন তিনি। তাকে প্রথমবার বাংলাদেশের জার্সিতে খেলতে দেখা যাবে আগামী ২৫ মার্চ, শিলংয়ে ভারতের বিপক্ষে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের ম্যাচে। দলের সঙ্গে খেলার পর্যাপ্ত সুযোগ না পেলেও তাকে ঘিরেই দল সাজিয়েছেন প্রধান কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একা হামজা আসলে কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবেন?
হামজার সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতা
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা মূলত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কিংবা রাইট-ব্যাক হিসেবে খেলেন। লেস্টার সিটির অ্যাকাডেমিতে বেড়ে ওঠা হামজা বার্টন অ্যালবিয়নে ধারে খেলতে গিয়ে পেশাদার ফুটবলে পা রাখেন। এরপর ২০১৭ সাল থেকে লেস্টারে ফিরে সিনিয়র দলের হয়ে ১০০টির বেশি ম্যাচ খেলেন তিনি। হয়ে উঠেন দলের রক্ষণভাগের অন্যতম হাতিয়ার।
২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয় হামজার। আর ২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল সুযোগ পান প্রথম একাদশে। ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট লেস্টারের সঙ্গে নতুন করে ৪ বছরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি লেস্টারের জার্সিতে প্রথম গোলের দেখা পান তিনি। নিউক্যাসলের বিপক্ষে ম্যাচটি ৩-০ গোলে জেতে লেস্টার।
২০২০ সালের ২২ অক্টোবর প্রথমবার ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ পান হামজা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত প্রথম ফুটবলার হিসেবে সেই প্রতিযোগিতায় গোলও করেন তিনি। উয়েফার ক্লাব প্রতিযোগিতায় ব্রিটিশ এশিয়ানদের মধ্যে তিনি মাত্র দ্বিতীয় (প্রথম মাইকেল চোপড়া) ফুটবলার হিসেবে গোলের দেখা পান। ২০২১ সালে লেস্টারের হয়ে এফএ কাপ জেতার স্বাদ পান তিনি। হামজা খেলেছেন ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়েও।
২০২২ সালের ১০ আগস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ক্লাব ওয়াটফোর্ডে ধারে যোগ দেন হামজা। আর এবার তাকে ধারে খেলতে নিয়ে গেছে ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপের দল শেফিল্ড ইউনাইটেড। বাংলাদেশে আসার আগেও তিনি ৯০ মিনিট খেলে এসেছেন এই দলের হয়ে। শেফিল্ড ডার্বি নামে পরিচিত এই ম্যাচে রায়ান ব্রুস্টারকে ১-০ গোলে হারিয়েছে হামজার দল। এত এত অভিজ্ঞতা যার, তাকে দলে পাওয়া বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বিশাল ব্যাপার।
হামজার বিশেষত্ব
লেস্টারের অনূর্ধ্ব-২৩ দলের অধিনায়কত্ব থেকে চেলসির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয় হামজার। সেই ম্যাচে জয় পায় লেস্টার। মিডফিল্ডে তার পারফরম্যান্স সবার নজর কাড়ে। ইংলিশ মিডিয়া ওই ম্যাচের আগে রিপোর্ট করেছিল ম্যাচটি না জিতলে কোচ পুয়েলকে বরখাস্ত করা হতে পারে। ১-০ গোলের জয়ে চাকরি বেঁচে যায় পুয়েলের।
একজন মিডফিল্ডারের যা যা গুণ থাকা দরকার তার সবই আছে হামজার। শক্তিমত্তা, পাসিং দক্ষতা আর আক্রমণে উঠে আসার দক্ষতা মিলিয়ে তাকে পূর্ণাঙ্গ মিডফিল্ডার হিসেবেই অভিহিত করা হয়। রক্ষণের জাল ছিন্ন করার দক্ষতা আর ডি-বক্সের সামনে তার সামর্থ্যের প্রমাণ তিনি অনেকবারই রেখেছেন। বেশ ভয়ডরহীন ফুটবল উপহার দিয়েছেন তিনি।
হামজার বাজারমূল্য
ফুটবলভিত্তিক ওয়েবসাইট ট্রান্সফারমার্কেটের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশি ফুটবলারদের সম্মিলিত বাজার মূল্যের চেয়ে হামজার একার বাজার মূল্য বেশি। হামজার বর্তমান বাজারমূল্য ৪.৫ মিলিয়ন ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ৫৯ কোটি টাকার বেশি)। ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ১০ মিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছিল তার বাজার মূল্য। বাংলাদেশের অন্য খেলোয়াড়দের মধ্যে হামজার পরে আছেন রাকিব হোসেন। এই রাইট উইঙ্গারের বাজারমূল্য আড়াই লাখ ইউরো।
গত ডিসেম্বরের হিসাবে, হামজা যোগ দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ দলের মোট বাজারমূল্য এখন সাড়ে ৭ মিলিয়ন ইউরোর বেশি। যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। দুইয়ে থাকা ভারতের বাজার মুল্য ৬ মিলিয়ন ইউরোর আশেপাশে। হামজা আসায় পুরো এশিয়ার মধ্যে বাজার মূল্যের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৯তম স্থানে।
হামজাকে ঘিরে প্রত্যাশা
হামজা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য গৌরবের নাম। তার ছোঁয়ায় বদলে যেতে পারে দেশের ক্লাব ফুটবল। তার জন্য ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর নজর থাকবে বাংলাদেশের ফুটবলে। জামাল, রাবিক, তারিকদের সঙ্গে মাঠের ফুটবলে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবেন তিনি, তা দেখতে আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে। হামজা যে আশার আলো জ্বেলেছেন, তা যেন আরও উজ্জ্বল শিখায় পরিণত হয়, সেই আশায় থাকবেন দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। হামজা আজ দেশে ফিরে বলেছেন, 'দেশে ফিরে ভালো লাগছে, আমি খুব রোমাঞ্চিত। আমার হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ। '
নিজের অভিষেক ম্যাচ নিয়ে হামজার বক্তব্য, 'কোচ কাবরেরার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। (ভারতের বিপক্ষে) ইনশাল্লাহ আমরা জিতব। বাংলাদেশকে নিয়ে কোচ হাভিয়েরের সঙ্গে বড় স্বপ্ন আছে আমার। ইনশাল্লাহ আমরা জিতে উন্নতি করতে পারব। ' এটাই তো চায় বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৫
এমএইচএম