ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

স্কুলে মানসম্মত শৌচাগার ও মাসিক ব্যবস্থাপনা কর্নার স্থাপনের দাবি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০২৩
স্কুলে মানসম্মত শৌচাগার ও মাসিক ব্যবস্থাপনা কর্নার স্থাপনের দাবি ছবি তুলেছেন জিএম মুজিবুর

ঢাকা: দশ বছরের বেশি বয়সী অনেক ছাত্রী বিদ্যালয়ের শৌচাগার ব্যবহার না করে বাড়ি ফিরে শৌচ কাজ সাড়ে। বিদ্যালয়ে শৌচাগার কম থাকা কিংবা নোংরা থাকার কারণে এমনটি করে থাকে তারা।

 প্রাকৃতিক এই কর্ম দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখার জন্য তারা বেশ জটিলতায় ভোগে।  

এছাড়া মাসিককালীন জরুরি সময়ে মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেই বিদ্যালয়গুলোতে। তাই দেশের সব স্কুলগুলোতে মানসম্মত শৌচাগার ও একটি করে মাসিক ব্যবস্থাপনা কর্নার স্থাপনের মাধ্যমে স্মার্ট স্কুলকলেজ ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে।

বুধবার (৯ আগস্ট) রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় দৈনিক কালের কণ্ঠের কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত ‘শহর এলাকার বিদ্যালয়গামী কিশোর - কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ভাবনা বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠক’ আলোচনা সভায় এ দাবি জানান বক্তারা।  

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, আজকের কিশোরী আমাদের মেয়ে, বোন, ভবিষ্যতের গর্ভধারিণী মা ও পরিবারের মূল চালিকাশক্তি। দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠার জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে আমরা সুস্থ মা, সুষ্ঠু জাতি ও সুষ্ঠু নারী নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হব।

কালের কণ্ঠ ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এবং আর্টিস্টিক কমিউনিকেশনের যৌথ উদ্যোগে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।  

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেন কালের কন্ঠের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে প্লান বাংলাদেশের কম্প্রিহেনসিভ সেক্সুয়্যালিটি এডুকেশন অ্যাডভাইজার চন্দন জেড গোমেজ।  

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।  

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন - অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নীলফামারী-৩ সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ সার্ভিসেস) ডা. মাহমুদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি অধ্যাপক ডা. এম কামরুজ্জামান মজুমদার, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) কেকা রায় চৌধুরী, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন নিগার সুলতানা, জয়া স্যানেটারি ন্যাপকিনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া মাজহার, আরবান এন্ড রুর‍্যাল ক্লাস্টার ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এর ডেপুটি ডিরেক্টর মঞ্জু মারিয়া পালমা, আরবান প্রোগ্রাম ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এর ম্যানেজার টেকনিক্যাল  জোয়ানা ডি রোজারিও, জাতীয় জরায়ু- মুখ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রর প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা, ক্যাম্প্যাইন লিড সাইডসেভার্স অয়ন দেবনাথ প্রমুখ৷ 

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় ৫৪টি ওয়ার্ডে কমিউনিটি ক্লিনিকের ডিজাইন করা হচ্ছে। এই হাসপাতালগুলো সম্পূর্ণ স্মার্ট ও ডিজিটাল পদ্ধতির হবে। যাতে নগরবাসী ভালো মানের চিকিৎসা সেবা পেতে পারে। পাশাপাশি  মাসিকের সময় মেয়েদের জন্য নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে ও বিদ্যালয়গুলোতে প্যাডের জন্য ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবস্থা করব। এ উপলক্ষে উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ২০ লক্ষ টাকা অনুদান দেয়া হবে।  

গোলটেবিল বৈঠকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ সার্ভিসেস) ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৪০ ভাগ। যা আগামীতে ধারণা করা হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ ভাগে গিয়ে পৌঁছাবে। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই গ্রামাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমানে সরকার উপজেলাসহ সমস্ত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে শিশু ও নাবালক স্বাস্থ্য কর্নার চালু করার নির্দেশ দিয়েছে।  

অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নীলফামারী-৩ সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, আমাদের বাচ্চাদের মাসিকের বিষয়ে আগে থেকেই ধারণা দিতে হবে। যাতে করে মাসিকের সময়ে তারা  আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারে। তাকে যেন অপ্রস্তুত না থাকতে হয়।  

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, নারী শিশুদের এখন অনেক আগেই ঋতুচক্র শুরু হচ্ছে, অনেকে ভয়ে এ বিষয়ে কিছু বলছে না। ঋতুচক্র সংক্রান্ত শিক্ষার প্রথম পাঠ ঘর থেকে শুরু করতে হবে। শিক্ষাক্রমে এ সংক্রান্ত শিক্ষা যুক্ত করে শিশুদের ঋতুচক্র ব্যবস্থাপনায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সরকারের কাছে আহ্বান জানাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যানিটারি ন্যাপকিন, পরিষ্কার পানি এবং বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করুন, এটি আমাদের দাবি।

এসময় জয়া স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া মাজহার বলেন,  পাঁচ বছর আগেও প্রকাশ্যে মাসিকচক্র নিয়ে কেউ কথা বলত না। এ বিষয়ে শিক্ষা আর সচেতনতার অভাব দূর করতে হবে। পাঁচ, ছয় বছরের কন্যাশিশু থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে এ সংক্রান্ত যোগাযোগের বিকাশে তৃণমূল থেকে কাজ করতে হবে। পাঠ্যক্রমে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা যুক্ত করতে হবে। স্যানিটারি প্যাডের ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন হল সহজলভ্যতা। কীভাবে এটা সাধারণ মানুষ কিনতে পারে সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর নজর দিতে হবে।  

প্ল্যান বাংলাদেশ কম্প্রিহেনসিভ সেক্সুয়ালিটি এডুকেশন অ্যাডভাইজর সৈয়দ মো নুরুউদ্দিন সাখাওয়াত বলেন, আমাদের সমাজে মাসিক চক্রের মতো একটা স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় শব্দ উচ্চারণে ভয় আছে। অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে যেখানে একজন নারী মাসিকের সময় দোকান থেকে প্যাড কিনতে গেলে অনেক সময় দোকানিরা অন্য দৃষ্টিতে দেখে। এরপর থেকে কিন্তু সেই নারী আর দোকানে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে না। রাজধানীতেও একজন নারী সহজে টয়লেট, স্যানিটারি প্যাড এবং স্যানিটারি বর্জ্য নিষ্কাশনের সুযোগ পান না। সেক্ষেত্রে মাসিকে হাইজিনের কিছুটা ঘাটতি দেখা দেয়। এজন্য আমাদের সমাজের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। কারণ আজকের কিশোরী আমাদের সমাজে আগামী দিনের সম্পদ। এই সম্পদের দেখভালের দায়িত্ব সমাজের সকলের। প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা মানুষের দ্বারে দ্বারে নিয়ে পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে, নারীদের পাশাপাশি পুরুষকেও যুক্ত করতে হবে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় সব শ্রম পরিবেশে মাসিক সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা প্রয়োজন।

জাতীয় জরায়ু- মুখ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রর প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা বলেন, অনেক স্বনামধন্য বিদ্যালয়গুলোতে  ছাত্রীদের জন্য ভালো টয়লেট এবং মিন্সট্রেশনের বিষয়ে প্যাডের তেমন কোনো ব্যবস্থা থাকে না। সে তুলনায় গ্রামে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে এ ধরনের সুবিধা আরও কম থাকে। তাই আমাদের এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। তাহলেই আমরা সঠিকভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারব।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি অধ্যাপক ডা. এম কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, হাইজিন ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে নারীরা নানা ধরনের সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ করে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টয়লেট ব্যবহারের উপযোগী নয়। এসব বিষয়ে আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।  

সাইডসেভার্সের ক্যাম্পেইন লিড অয়েন দেবনাথ বলেন, এসজিডি লক্ষ্য মাত্রায় ১৭টি লক্ষ্যই ঋতুচক্র সুরক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অথচ এ সংক্রান্ত ট্যাবু এখনো দূর হয়নি। জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য আমরা বিধিবদ্ধ টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানাই।

বাংলাদেশ সময়: ১২২১ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০২৩
ইএসএস/এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।