জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার এ প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি-অনিয়মসহ নানা কারণে আলোচনায়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাসের বেশি সময় পার করলেও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল চলছে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীদের প্রেসক্রিপশনে। ফ্যাসবাদী সিন্ডিকেট নানাভাবে খোলস বদলে নতুন আধিপত্যের জাল বিস্তার করেছে। পতিত সরকারের সুবিধাভোগীদের কেউ নাম লেখাচ্ছেন বঞ্চিতদের তালিকায়, কেউবা সুশীলদের ব্যানারে গড়ে তুলছেন নতুন সিন্ডিকেট।
এই সিন্ডিকেটের হাতে হাসপাতালটির সাধারণ চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয়, আউট সোসিংয়ের কর্মচারীসহ সবাই জিম্মি। তাদের কথা না মানলেই আসে হুমকি, বঞ্চনা, বদলি এবং ওএসডি। এদের খপ্পরে পড়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে সেবা নিতে আসা রোগীরাও পড়ছেন নানা ভোগান্তিতে।
সরেজমিনে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে গিয়ে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে তৎপর ছিলেন ডা. হেলাল আহমেদ। গত ৩ আগস্ট শান্তি মিছিলের নামে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে প্রতিরোধের মিছিলে সরাসরি অংশ নেন ডা. হেলাল আহমেদ ও তার সহযোগীরা।
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক হয়েও আওয়ামী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড, অ্যাডলসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, জেরিয়াট্রিক অ্যান্ড অর্গ্যানিক সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ তারিকুল আলম সুমন, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. অভ্র দাস ভৌমিক। এই সিন্ডিকেটের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ডা. অভ্র দাস ভৌমিক। অভ্র দাস ভৌমিক ও হেলাল আহমেদের নেতৃত্বেই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের অঘোষিত নির্বাচনী ক্যাম্প।
আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ডা. অভ্র দাস ভৌমিক, সহ-সভাপতি ছিলেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ডা. তারিকুল আলম সুমন। বিগত সময়ে স্বাচিপ ব্যানারে নৌকার পক্ষে একাধিক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এসব মতবিনিময় সভায় অতিথি করা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানাকে।
এ সব মতবিনিময় সভায় এই সিন্ডিকেটের সব চিকিৎসক নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন, যা সরকারি চাকরির বিধিবহির্ভূত। নৌকার প্রচারনায় অংশ না নিলেই নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হতে হতো জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সেই পুরনো সিন্ডিকেট এখনও আধিপত্য বিস্তার করে নিয়ন্ত্রণ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সফিকুল কবির জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, ৫ আগস্টে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলেও তাদের প্রেতাত্মাদের পতন হয়নি। এরাই খোলস বদলে নতুন রূপ ধারণ করেছে। এই ইনস্টিটিউটে এতদিন যারা স্বাচিপের নেতা ছিলেন, যারা শান্তি মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রামে জোর করে নিয়ে গিয়েছেন তারাই এখন নতুন ধারার রাজনৈতিক পরিচয় দিচ্ছেন। এসব বিষয় নিয়ে আমি ডিডি থাকা অবস্থায় তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তারা উচ্চ তদবিরে আমাকেও ওএসডি করেছে। তাহলে বুঝতে হবে তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়!
তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে যারা এতদিন রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং আধিপত্য বিস্তার করেছেন, চিকিৎসক হিসেবে তারা এই হাসপাতালে সেবাদানের নৈতিক অবস্থান নষ্ট করেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে ইনস্টিটিউটে দায়িত্ব পালন করা নার্সিং সুপারভাইজার ফিরোজা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, যেসব নার্স ও চিকিৎসকরা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন তারাই পদোন্নতি পেতেন। আর যারা তাদের কথা শুনতেন না তারা হতেন বঞ্চিত। এসব কর্মকাণ্ডে আমাদের সবাইকে অংশ নিতে বাধ্য করা হতো। কখনো হাসপাতালে কখনো হাসপাতালের বাইরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হতো।
তিনি বলেন, স্বাচিপের চিকিৎসকরা এখনো হাসপাতাল দখল করে রেখেছে। ডা. তারিকুল আলম সুমন ও ডা. হেলাল আহমেদরা আওয়ামী লীগকে নিয়ে যেসব মতবিনিময় সভা করতেন, সেসব সভায় আমাদের যেতেই হতো। না গেলে কখন কী সমস্যা হয়, এই ভয়েই আমরা যেতাম। এখনো তারা আমাদের প্রশিক্ষণ দেবে না এবং বদলি করার ভয় দেখিয়ে তাদের দলে ভিড়তে বাধ্য করছে।
একই প্রতিষ্ঠানের আরেক সিনিয়র স্টাফ নার্স নমিতা হালদার বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের নার্সদের পদন্নোতির ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি মেইনটেইন করা হয়। কিন্তু আমি এবং আমার অন্য এক সহকর্মীকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। আমি পদন্নোতির তালিকায় ৭ নম্বরে থেকেও বঞ্চিত হয়েছি। আমাকে বাদ দিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয় তালিকায় ২৫ নম্বরে থাকা জাকিয়া সুলতানা নামের এক সিনিয়র স্টাফ নার্সকে।
তিনি বলেন, ডা. তারিকুল আলম সুমন, ডা. হেলাল আহমেদরা এখনো আমাদের পারেন তো ফেলে দেন, পারলে আমাদের গলায় চাপ দিয়ে মেরে ফেলেন। এখনো তাদের দাপট চলছেই। এখনো তারা ইনস্টিটিউট দখল করে রেখেছেন। এখানে বর্তমান যে নার্সিং সুপারিন্টেনডেন্ট তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। তাকে দিয়েই সব অনিয়ম হয়।
৫ আগস্টের পর থেকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিতর্কিত চিকিৎসাকদের বদলি এবং শাস্তির দাবিতে একাধিক মানবন্ধন করা হয়েছে। এসব মানববন্ধনে হাসপাতালটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আওয়ামী সরকারের এসব এজেন্ট চিকিৎসকদের শাস্তির দাবি জানান। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আওয়ামীপন্থি এসব চিকিৎসকদের অপকর্মের ছবি দিয়ে ব্যানার টানিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
দীর্ঘদিন মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চলতে থাকা অনিয়ম, ইনস্টিটিউটকে রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার ও আউটসোর্সিং খাতে অনিয়মের প্রতিবাদ এবং এএসপি আনিসুল করিমের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত চক্রের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করায় ফ্যাসিবাদী সিন্ডিকেটের চক্রান্তে ওএসডি হয়েছেন এই ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক সফিকুল কবির জুয়েল।
ওএসডির পর হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর করা ওই আবেদনে বলা হয়, এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. অভ্র দাস ভৌমিক সদ্য পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী ও কোটা সংস্কার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি ও তার সহযোগী চিকিৎসকরা বিগত ১৬ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে অর্থনৈতিক অনিয়মসহ ভয়ানক দুর্নীতি ও বৈষম্য তৈরি করেন। বিগত ৫ আগস্ট তৎকালীন সরকার প্রধান পালিয়ে যাওয়ার পর ডা. মোহাম্মদ শফিকুল কবিরকে উপ-পরিচালক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করে বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া দুর্নীতিগুলো তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মাত্র ১০ দিনের মাঝেই তারা ফ্যসিবাদীর চক্র ব্যবহার করে ডা. মোহাম্মদ শফিকুল কবিরকে অন্যায়ভাবে গত ১ সেপ্টেম্বর ওএসডি করান। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা যিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন পরিচালক ছিলেন, তার সহায়তায় এটি সম্ভব হয়েছে। কারণ সচিবালয়ে তার ফাইলে ওএসডির জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ নেই।
এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করেন ডা. সফিকুল কবির জুয়েল। ওই আবেদনে তিনি তার ওএসডির বিষয়ে ব্যাখ্যা চান। আবেদনে তিনি বলেন, আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই মাত্র ৮ দিনের মাথায় এই অনৈতিক, অবৈধ ওএসডির বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য অনুরোধ করছি। একইসাথে এই ওএসডি সম্পর্কে তিনি সচিব বরাবর লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে এ বিষয়ে জানতে চান।
অভিযোগের বিষয়ে জেরিয়াট্রিক অ্যান্ড অর্গ্যানিক সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ তারিকুল আলম সুমন বাংলানিউজকে বলেন, তারা যেসব অভিযোগ এনেছে, এসব মিথ্যা কথা। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে কিন্তু সবাইকে জোর করে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি মিথ্যা। আমাদের হাসপাতালে এ ধরনের পরিবেশ ছিল না।
তিনি বলেন, আউটসোর্সিং খাতে অনিয়মে জড়িত যে মিরাজের কথা বলছেন, তিনি আমার আত্মীয়। তার বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২৪
জিসিজি/এমজেএফ