জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার এ প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি-অনিয়মসহ নানা কারণে আলোচনায়।
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হতাহতের ঘটনা, সংঘর্ষ, রক্তপাত প্রত্যক্ষ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না অনেকেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন দমনে ফ্যাসিবাদী সরকারের পেটোয়া বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন তারা। তাদের অনেক সহপাঠীর অঙ্গহানি হয়েছে, কেউ কেউ চোখ হারিয়েছেন, অনেকেই এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয়ে বা সহিংসতা প্রত্যক্ষ করে অনেকেই ট্রমাগ্রস্ত হয়ে আছেন। স্বাভাবিক জীবনই যেন অচেনা লাগছে তাদের!
এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের আত্মীয়-স্বজন এবং আহত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ফ্রি মানসিক সেবা দিতে সেপ্টেম্বরে চালু করা হয় বিশেষ ওয়ার্ড। এতে রোগীদের বিভিন্ন থেরাপি ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু ওয়ার্ডটিতে পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স ও সেবা না পাওয়াসহ নানা অভিযোগ করেছেন রোগীরা।
সরেজমিনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের জন্য বিশেষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সহিংসতার শিকার কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী ১৫ থেকে ২০ জন নানা ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে এই বিশেষ ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ওয়ার্ডটিতে থাকা একাধিক রোগীর অভিভাবকরা যথাযথ সেবা না পাওয়ার অভিযোগ করেন।
তারা বলেন, ফ্রি চিকিৎসার কথা বলা হলেও দুই-একটি ওষুধ হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে। বাকি ইনজেকশন ও ওষুধ আমাদের কিনে আনতে হচ্ছে। সময়মতো ডাক্তার আসে না, বার বার বলেও ডাক্তার পাওয়া যায় না, ওয়ার্ড বয় দিয়েই চলে এই বিশেষ ওয়ার্ড। এ ছাড়া তাদের কথামতো না চললে নানা ধরনের ভয়-ভীতিও দেখায়।
বিশেষ ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক কমল চন্দ্র দাস। তিনি ‘গহীন বালুচর’ চলচ্চিত্রের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন তিনি একটি ডকুমেন্টরি তৈরি করতে বের হন। কিন্তু চিত্রধারণের সময় রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ দেখে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হন। এরপর থেকেই চিকিৎসা শুরু হয় কমলের। প্রথমে গুলশানের বিকন পয়েন্টে চিকিৎসা নিলেও পরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
কমল চন্দ্র দাসের মা কল্পনা রানী দাস বাংলানিউজকে বলেন, এই হাসপাতালে কী চিকিৎসা দিচ্ছে বুঝতে পারছি না। কতদিন হলো এখানে আমার ছেলেকে নিয়ে আসছি, কোনো পরিবর্তন দেখছি না। যে পাগল নিয়ে আসছি সেই পাগলই দেখতেছি! ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যায় না। ডাক্তারদের পাঁচতলা ছয়তলা খুঁজে দেখা করতে হয়। কিছু ওষুধ তারা দেয়, বাকিগুলো আমাদের কিনে আনতে হয়। যেসব ইঞ্জেকশন ডাক্তাররা লেখেন, সেইসব ইঞ্জেকশনের বিষয় কিছু না বুঝলেও নার্সরাও সহযোগিতা করেন না।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ সময় ওয়ার্ড বয়রাই আসে, নার্স বা ডাক্তাররা বেশি আসে না। জরুরি প্রয়োজন হলে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ডাক্তার পাওয়া যায়। কোনো বিষয়ে একবারের বেশি জিজ্ঞেস করলে খারাপ ব্যবহার করে। কতদিন এই চিকিৎসা নিতে হবে, সেটাও কেউ স্পষ্ট করে বলে না।
রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা জসিম (ছদ্মনাম) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। ওই অভিভাবক বলেন, আন্দোলনের পর থেকে ঘুমাতে পারছে না। ঘুমালেই চিৎকার দিয়ে ওঠে। একা একা বিড় বিড় করে কথা বলে। কিছু খেতে পারছে না। সারা রাত জেগে থাকে। হঠাৎ রেগে যায়। অক্টোবর মাসে এখানে নিয়ে এসেছি। প্রথমে কিছু দিন ভালো চিকিৎসা পেলেও এখন তেমন কোনো সেবা পাচ্ছি না। বেশির ভাগ ওষুধ আমাদের কিনে দিতে হয়। অথচ আমাদের ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার কথা। ডাক্তার বা নার্সদের একবারের বেশি দুইবার ডাক দিলেই রেগে যায়, খারাপ ব্যবহার করে। কবে যে এখান থেকে মুক্তি পাব, সেটাও বলতে পারছি না।
এমন অভিযোগ শুধু জসিম বা কমল চন্দ্র দাসের মা কল্পনা রানীর নয়। এ ওয়ার্ডে একাধিক রোগীর অভিভাবকরা যথাযথ সেবা না পাওয়ার অভিযোগ করেন।
এ বিভাগের ডিউটি ডাক্তাররাও সিনিয়র ডাক্তারদের কল করে সাড়া না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। একজন ডিউটি ডাক্তার বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে একাধিকবার কল করেও পাচ্ছি না। পরে বাধ্য হয়েই আমি সেই ডাক্তারকে কল করে জানিয়েছি বিষয়টি। ফোন করার অনেকক্ষণ পরে তিনি রেসপন্স করেন। এমন ঘটনা পর পর দুই-তিনদিন হয়েছে। কার কবে ডিউটি, এটা রুটিন থাকার পরেও আমাকে কেন ফোন করতে হবে? আসলে এখানেও কো-অপারেশনের বড় একটা ঘাটতি দেখছি। যারা এখানে অসহযোগিতা করছেন তারা সবাই চিহ্নিত।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালটির উপপরিচালক ডা. শফিকুল কবির জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, ওয়ার্ডটি চালুর সময়ই আমি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলাম। যারা শান্তি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা তো নিশ্চয়ই এই আন্দোলনে অসুস্থ হওয়া শিক্ষার্থী আর তাদের পরিবারের জন্য কাজ করবেন না। ফলে সঙ্গত কারণে তারা বাধা দেন। বিশেষ ওয়ার্ড চালু হলেও পর্যাপ্ত ডাক্তার এবং নার্স সরবরাহ করা হয় না। সবসময় ওয়ার্ড বয়ও রাখা হয় না। অথচ আমি চেয়েছিলাম ওয়ার্ডটিতে বিশেষভাবে সেবা দেওয়া হবে। এর একটাই কারণ— ওয়ার্ডটি আমার উদ্যোগে চালু বলেই। আশা করছি আওয়ামী লীগের দলীয় চিকিৎসকদের মুক্ত করতে পারলেই এই হাসপাতাল চিকিৎসা সেবার একটি মডেল হবে।
অসহযোগিতার অভিযোগ চিকিৎসকদেরও
অ্যাডিকশন সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. সাইফুন্নাহার বাংলানিউজকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের জন্য যে ওয়ার্ড চালু হয়েছে, সেখানে আমারও একটি রোগী রয়েছে। সেই রোগীর পরিবারও যথাযথ সেবা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে। এখানে প্রধানত অসহযোগিতার সমস্যাটা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ওয়ার্ডে যেসব জুনিয়র ডাক্তাররা দায়িত্বে থাকেন তারা বেশির ভাগ সময় রোগীর সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসককে অবহিত করেন না। ফলে সেবাদানের এই চেইনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি টেলিসাইকিয়াট্রি বিভাগের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এ বিভাগে আগে যেভাবে ব্যবস্থাপনা করা গেছে, এখন সেটি বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেবা নিতে আসা এই ব্যক্তিদের উগ্র মেজাজ, ঘুমের সমস্যা, ভীতি এবং অস্থিরতা কাজ করছিল। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনেকেই জানেন না, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের মতে, আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের ‘একিউট স্ট্রেস ডিস-অর্ডার’ এবং পরবর্তী সময়ে ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার’ বা ‘পিটিএসডি’ হতে পারে। রোগীদের সহিংসতার ভয়ংকর স্মৃতি ফিরে ফিরে আসতে পারে। সব সময় অনিশ্চয়তা, বিপদের শঙ্কায় তটস্থ থাকতে পারেন। ঘুমের সমস্যা, দুঃস্বপ্ন দেখা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশে অক্ষমতা, অমনোযোগ, ভুলে যাওয়া প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় অনেকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে পারেন।
প্রথম পর্ব
এখনো ‘ফ্যাসিস্ট সিন্ডিকেটের’ কবলে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২৪
জিসিজি/এমজেএফ