ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মেঘনায় অবৈধ ড্রেজিংয়ে বালু উত্তোলন, প্রশাসন নীরব

মেহেদী নূর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২৩
মেঘনায় অবৈধ ড্রেজিংয়ে বালু উত্তোলন, প্রশাসন নীরব ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে দেদারসে তোলা হচ্ছে বালু। ছবি: বাংলানিউজ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে লাখ লাখ ফুট বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী একটি চক্র। কোনোরকম সরকারি ইজারা ছাড়াই প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করে প্রায় এক মাস ধরে চলছে বালু তোলার মহোৎসব।

কিন্তু নীরব ভূমিকায় রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় ছয়টি ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলে তাদের কাজ।  

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তারা অবৈধভাবে কাজটি করে যাচ্ছেন। এতে পানির প্রবাহে গতি পরিবর্তন হওয়ায় নদীর পাড় ভেঙে এলাকার ফসলি জমিসহ বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। তবে বালু উত্তোলনকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ভৈরবের সাদেকপুর ইউনিয়নের মেন্দিপুর গ্রামের মেঘনা নদীর অংশ থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের নাম করে মাসখানেক ধরে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। একইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা অংশ থেকেও নিয়মিত বালু তোলা হয়। ফলে এর প্রভাব পড়ছে উপজেলার ১০ থেকে ১৫টি গ্রামের ওপর।

নদীতে বালু উত্তোলনের জন্য বসানো ড্রেজার মেশিন।  এদের সঙ্গে যুক্ত বাল্কহেড।

জানা গেছে, এ বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত ভৈরব পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোশারফ হোসেন মিন্টু ও সেখানকার উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মো. মোশারফ হোসেন মুসা। যদিও বালু উত্তোলনের জন্য তাদের কাছে কোনো ধরনের অনুমতি নেই। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  

দেদারসে বালু উত্তোলনের কারণে ভেঙে যাচ্ছে মেঘনার পাড়।  ছবি: বাংলানিউজ

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর মাঝখানে ও কূল ঘেঁষে ছয়টি ড্রেজার মেশিন বসানো। এর প্রতিটি মেশিনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একেকটি বাল্কহেড। প্রতিটি বোটে ১২/১৩ জন লোকের পাহারা। বেলা ১২টার দিকে দেখা গেল মেন্দিপুর এলাকার মেঘনা নদীর কূল ঘেঁষে ছয়টি ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে দেদারচ্ছে তোলা হচ্ছে বালু। সেই বালু বাল্ডহেডের মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ সময় সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি দেখে তারা নড়েচড়ে বসে। ছবি তুললে তাদের অনেককেই ক্ষুব্ধ হয়ে সাংবাদিকদের পিছু নিয়ে ধাওয়া করতে থাকে। তারা তাদের স্পিডবোট দিয়ে সাংবাদিকদের স্পিডবোটকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই প্রভাবশালী মহলটি সাময়িক সময়ের জন্য বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিনগুলো বন্ধ করে দেয়।  

সরাইল উপজেলার কয়েকটি গ্রামের একাধিক গ্রামবাসী বালু উত্তোলনের কারণে দুর্দশার কথা জানিয়ে বলেন, এই অবৈধ বালু উত্তোলন আমাদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে। আমাদের গ্রাম নদী গ্রাস করে নিচ্ছে।  

প্রবীণ বাসিন্দা নিজাম মিয়া বলেন, আমার তিন কানি জমি ছিল। এর মধ্যে দুই কানি জমির মাটি ভেঙে নদীতে চলে গেছে। আমি ছাড়াও অন্যান্য মানুষের ফসলি জমিও চলে গেছে। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমাদের জীবনটা বাঁচব।

আজব গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা কাজী লিয়াকত মিয়া বলেন, নদীটা অনেক দূরে ছিল। আমরা নদীর অনেক দূরে গিয়ে গবাদি পশু গোসল করতাম। ড্রেজারে বালু তোলার ফলে ধীরে ধীরে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রায় আধা মাইল পর্যন্ত চলে এসেছে। এখন হুমকির মুখে আমাদের কয়েকটি গ্রাম রয়েছে।

নদীর পাড়েই দু’তলা ভবনের মালিক জুনায়েদ মিয়া বলেন, প্রতিদিন একটু একটু করে পাড় ভেঙে চলছে। মূলত অবাধে বালু তোলার কারণে সব সময় আতঙ্কে থাকি। কখন জানে আমাদের ভবন পানিতে চলে যায়। প্রভাবশালী চক্রটি প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবাধে বালু উত্তোলন করছে।

সরাইলের অরুয়াইল ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মো. আবুল বাশার বলেন, ‘ভৈরবের মুসা মিয়ার (মোশারফ হোসেন) নেতৃত্বে অনুমতি ছাড়াই এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হলে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে। ’ 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভৈরব পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোশারফ হোসেন মিন্টু মোবাইল ফোন বলেন, ‘বৈশাখ মাস পর্যন্ত আমি নদী ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলন করেছি। আমার সঙ্গে ভৈরব ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজনও ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল। এখন কে বা কারা বালু তুলছে জানি না। ’ 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ড্রেজারগুলো বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বালু তোলে। আমার কাজের সময় ব্যবহার করা একই রকম ড্রেজার যদি তুলে থাকে তাহলে তো আমার কিছুর করার নেই। ’ 

এ বিষয়ে ভৈরবের আওয়ামী লীগ নেতা মো. মুসার মোবাইল ফোন নম্বরে বেশ কয়েকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাদেকুর রহমান সবুজ বলেন, ‘নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ। মন্ত্রণালয় থেকেও এই বিষয়ে আমাদের চিঠি দিয়েছে। শুনেছি কখনো তারা মেন্দিপুর আবার কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের অংশে বালু তুলে। আমাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পেরও কাজ শেষ। বালু উত্তোলনকারীরা আসলে আমাদের কথা বলে সুবিধা নিতে চায়। যারা বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা জয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুর রহমানের সঙ্গে।  

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরকারিভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন বর্তমানে বন্ধ আছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ভাঙন রোধে সরাইল, পানিশ্বরসহ বিভিন্ন ভাঙনপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে সম্ভাব্যতা প্রকল্পের কাজ চলছে। সম্ভাব্যতা প্রকল্পের সুপারিশের আলোকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে সমন্বিতভাবে ওই অঞ্চলগুলোতে স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।