ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় চলে নিহত খাইরুলের পরিবার

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২৩
সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় চলে নিহত খাইরুলের পরিবার

নাটোর: নাটোরের লালপুরে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে নিহত যুবলীগ নেতা খায়রুল বাশারের স্ত্রী-সন্তানের আয়ের একমাত্র পথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র। তবে পারিবারিকভাবে কিছুটা আয় হলেও মানবেতর জীবন-যাপন করেন স্ত্রী-সন্তানরা।

 

ইতোমধ্যে তার ছেলে জুবায়ের হোসেন এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। মেয়ে খাদিজাতুল কুবরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।

বাবার মৃত্যুর সময় জুবায়ের সপ্তম শ্রেণিতে ও মেয়ে খাদিজাতুল কুবরা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্ত্রীর নামে ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র খুলে দিয়েছিলেন। যার মুনাফা দিয়ে তাদের সংসার চলে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী লিপি খাতুন জীবনের সঙ্গে লড়াই করে দুই সন্তানকে মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু চাহিদা মোতাবেক আর্থিক সুবিধা না থাকায় তাকে অনেকটাই কষ্ট করতে হচ্ছে।

 জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জেলার লালপুর উপজেলার কদমচিলান ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খায়রুল বাশারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় জামায়াত-শিবির কর্মীরা। পরে হত্যার ঘটনায় খাইরুলের ভাই শাহীনুর রহমান বাদী হয়ে লালপুর থানায় একটি মামলা করেন। দেড় বছরের মাথায় পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়। ছয়জনের সাক্ষ্য শেষ হওয়ার পর ২০১৭ সালে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে রিট করলে মামলাটি স্থগিত হয়ে যায়।

পরে মামলাটি বিচারের জন্য রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতে যায়। কিন্তু এরই মধ্যে মামলার নথিপত্র গায়েব হয়ে গেলে মামলা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। পরে ২০১৮ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুলের সহায়তায় মামলার ‘মিসিং’ নথি উদ্ধার করা হয়। এছাড়া উচ্চ আদালত স্থিতাবস্থা তুলে নিলে রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি আবার চালু হয়। ঘটনার দীর্ঘ ১০ বছর পর মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) বেলা পৌনে ১টার দিকে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে চাঞ্চল্যকর যুবলীগ নেতা খায়রুল বাশার হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।

রায়ে জামায়াত-শিবিরের ১৩ নেতাকর্মীকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অপর ৫৪ জন আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।

রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক মো. মহিদুজ্জামান লালপুরের খায়রুল বাশার হত্যা মামলার এই রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় খাইরুলের স্ত্রী লিপি খাতুন ও তার তিন সন্তান উপস্থিত ছিলেন। এর আগে চলতি বছরের ১৪ নভেম্বর (মঙ্গলবার) শুনানি শেষে গত ২৬ নভেম্বর মামলাটির রায়ের দিন ধার্য করেছিলেন রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালত।

নিহত খাইরুল উপজেলার কদিমচিলান ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি পেশায় একজন নিরাপত্তাপ্রহরী এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘিরে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে তাণ্ডবে বাড়িতে হামলা করে তাকে হত্যা করা হয়।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন খাইরুল বাশার দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ শুনে তিনি ঘর থেকে বের হন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জামায়াত-শিবিরের কয়েকজন নেতা-কর্মী খাইরুলকে ঘিরে ধরেন। তারা রামদা, চায়নিজ কুড়াল দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খাইরুলকে হত্যা করেন।

খাইরুলকে বাঁচাতে তার চাচা মজনু ও জলিল এগিয়ে এলে তাদেরও কোপানো হয়। এ সময় ওই এলাকার কয়েকটি বাড়ি ও পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র লুট করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। আর হত্যার ঘটনায় খাইরুলের ভাই শাহীনুর রহমান বাদী হয়ে লালপুর থানায় একটি মামলা করেন।

এদিকে মামলা দায়েরের দেড় বছরের মাথায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ছয়জনের সাক্ষ্য শেষ হওয়ার পর ২০১৭ সালে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে রিট করলে মামলাটি স্থগিত হয়ে যায়।

পরে জানা যায়, মামলার নথি ‘মিসিং’ হয়ে আছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও নথি পাওয়া যাচ্ছিল না। সংসদ সদস্য পরে তাদের নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে যান। তার মাধ্যমে এক সহকারী রেজিস্ট্রারের চেষ্টায় দীর্ঘ দুই বছর পর নথি উদ্ধার হয়। পরে উচ্চ আদালত স্থিতাবস্থা তুলে নিলে রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি আবার চালু হয়।

নিহত খায়রুল ইসলামের ছেলে জুবায়ের হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মামলার বিচার কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আসামিপক্ষ মীমাংসা করার জন্য নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছিলেন। বাদীকে বেশ কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করেছে তারা। এরপর বাড়ি ছেড়ে তিনি ঢাকায় অবস্থান নেন। এমনকি তার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এ নিয়ে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কেননা আদালতের রায়ে জামায়াত-শিবিরের ১৩ নেতাকর্মীকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলেও তারা কেউ আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। তারা সবাই পলাতক রয়েছেন।

রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালতের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট এন্তাজুল হক বাবু বাংলানিউজকে জানান, এই মামলার মোট আসামি ছিলেন ৬৭ জন। এর মধ্যে তিনজন মারা যাওয়ায় তারা এমনিতেই খালাস। বাকি ছিলেন ৬৪ জন। এর মধ্যে ১৩ জনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই পলাতক আছেন। আর একজন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। তাই খালাসের মোট সংখ্যা ৫৪ জন।

নিহত খাইরুলের স্ত্রী লিপি খাতুন বলেন, এই রায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। রায়ে তারা আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড আশা করেছিলেন। কিন্তু রায়ে কোনো আসামির সর্বোচ্চ সাজা হয়নি। তাই এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন। তাছাড়া আসামির লোকজন এখনও তাদের হুমকি দিচ্ছেন। মামলার বাদী তার দেবর শাহীনুর রহমান এখনও বাড়ি ছাড়া। আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা না হওয়া পর্যন্ত তাদের সংশয় কাটবে না। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি ও তার সন্তানের চোখে এখন শুধুই অন্ধকার।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তার স্বামী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ছিলেন। সেদিনও জোহরের নামাজ পড়ে এসে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। তার অপরাধ ছিল তিনি নৌকায় ভোট দিতেন। আর সেই অপরাধে স্বামীকে জীবন দিতে হলো জামায়াত-শিবিরের হাতে। মৃত্যুও আগে আগে আমার স্বামী হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২৩
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।