ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সিলেটের তারাপুর চা বাগান

আয় নেই, তাই টিলা কেটে মার্কেট নির্মাণ!

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৮ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০২৪
আয় নেই, তাই টিলা কেটে মার্কেট নির্মাণ!

সিলেট: দেবোত্তর সম্পত্তি হওয়ার কারণে রাগিব আলীর হাত ছাড়া হয় তারাপুর চা বাগান। আদালত থেকে বাগানটির দায়িত্ব পান সেবায়েত পঙ্কজ দেবনাথ।

তিনি বাগানটি চালাতে ব্যর্থ হন।

এখন বাগানটি পরিচালনা করছে কমিটি। যে কারণে অর্থ সংকটে গত জানুয়ারি থেকে বন্ধ আছে বাগানের সব কার্যক্রম। আর ঢিলেঢালা মালিকানার কারণে বাগান হয়েছে বিবর্ণ। এখন দখলদারদের চোখ পড়ছে বাগানের চারদিকে।

কেউ মন্দিরের নাম ব্যবহার করে টানাচ্ছেন সাইনবোর্ড। কোথাও মন্দির ও চা শ্রমিকদের ব্যয় নির্বাপণের অজুহাত দেখিয়ে চা বাগানের টিলা কেটে তৈরি করছেন মার্কেট-দোকান। চা শ্রমিকদের কল্যাণে নির্মাণাধীন থাকাবস্থায়ই প্রভাবশালীরা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। বাগানের টিলা কেটে দোকান-কোটা নির্মাণে সরাসরি জড়িত বাগান ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী।

মন্দির ও চা বাগানের শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে তারাপুর চা বাগানের টিলা কেটে দোকান-কোটা নির্মাণ বন্ধে এবং অবৈধ সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা।

গত ২৪ জুন জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সিলেট সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের করেরপাড়া (পাঠানটুলা) পয়েন্ট সংলগ্ন স্থানে চা গাছ ও টিলা কেটে অবৈধ দখলদাররা দোকান-কোটা নির্মাণ করছে। অবৈধ মুনাফা লাভের উদ্দেশে স্থানীয় একটি চক্র ও তারাপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক এবং অসাধু কর্মচারীদের সহায়তায় বাগানের টিলা ও চা গাছ কেটে এই অপকর্ম করছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

অভিযোগকারীদের দাবি, আইনত চা বাগানের ভূমি, চা উৎপাদন ব্যতিরেকে অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণ করার সুযোগ নেই। তাই তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

ইতঃপূর্বে সিলেট সিটি করপোরেশন ভূমি সংলগ্ন এলাকায় একটি দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে। প্রতিদিন ওয়াকওয়েতে আসেন দর্শনার্থীরা। মূলত; ওয়াকওয়ে কেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চা গাছ ও টিলা কেটে সবুজের বুকে উঠছে দালান।

স্থানীয় বাসিন্দা কয়েছ আহমদ জানান, যে স্থানে দোকান-কোটা নির্মাণ হচ্ছে, এটি তারাপুর বাগানের জায়গা। কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল তারাপুর চা বাগানের শ্রমিকদের আয়ের উৎস তৈরির ফন্দি এঁটে চা গাছ ও বাগানের টিলা কেটে মার্কেট ও দোকান-কোটা নির্মাণ করছে।

এছাড়া সিটি করপোরেশনের করা ওয়াকওয়ের জায়গাটিও তারাপুর বাগানের বলে দাবি করেন স্থানীয়দের অনেকে। এর আগেও এভাবে চা শ্রমিকদের স্বার্থের কথা তুলে ধরে দোকান-কোটার মালিক বনে গেছে একটি চক্র।

সরেজমিন দেখা যায়, বাগানের পাশ ঘেঁষে পাঁচটি দোকান-কোটার মার্কেট তৈরি হচ্ছে। টিলাটির স্থানে আগে চা গাছ ছিল। বাগানের টিলার একপাশ কেটে ফেলা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, মার্কেটের দোকান-কোটাগুলো এরই মধ্যে মালিকানায় চলে গেছে। তবে সেসব প্রভাবশালীদের নাম মুখে আনতে ভয় পান অনেকে। তাই নাম বললে প্রাণও দিতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তারা।

বাগানের টিলা কেটে মার্কেট নির্মাণকারী ঠিকাদারের দায়িত্বে থাকা তাপস দাস বলেন, ১০ ফুট ও ১৫ ফুটের পাঁচটি দোকান-কোটা নির্মাণ করা হচ্ছে। শ্রমিকরা ১৫ দিন ধরে কাজ করছেন। এখানে তারাপুর বাগান ম্যানেজার কাজ করাচ্ছেন।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য নিপেন্দ্র কুমার দেব নিপু বলেন, তারাপুর বাগানের টিলা ও চা গাছ কেটে মার্কেট-দোকানকোটা তৈরি হচ্ছে। ভূমিটি চা বাগানের দেবোত্তর সম্পদ। এখানে স্থাপনা তৈরি কিংবা বিক্রির কোনো অনুমতি নেই। এ বিষয়ে আমরা সিটি করপোরেশনের মেয়র, জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ দিয়েছি।

তারাপুর চা বাগানের ম্যানেজার রিংকু চক্রবর্তী বলেন, যেখানে মার্কেট ও দোকান-কোটা নির্মাণ হচ্ছে, এটি চা বাগানের নিজস্ব ও দেবোত্তর সম্পত্তি। জায়গাটি ২০২১ সালে অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়। বারবারই ভূমি দস্যুদের পক্ষে সন্ত্রাসীরা দখলের চেষ্টা করে। গত জানুয়ারি মাস থেকে তহবিল সংকটের কারণে চা বাগান বন্ধ হয়ে আছে। আমার ৪১০ জন চা শ্রমিক না খেয়ে আছেন। তারা বাইরে কাজ করে জীবনযাপন করছেন। এতো কঠিন প্রেক্ষাপটে ডিডিএল, ভ্যালি সভাপতি ও সেক্রেটারি, পঞ্চায়েত সভাপতি মিলে দফায় দফায় বৈঠক করি। এরপরও সমস্যার সমাধান করতে পারছি না, তহবিল নেই।

তিনি বলেন, এই সম্পত্তির ওপর দেবতার মন্দিরের নামে ২-৪টি দোকান-কোটা করা হয়। তা দিয়ে চা বাগানের শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ করে বাগানটি চালু করতে পারবো। এখন চায়ের মৌসুম, মূল উদ্দেশ্য হলো মন্দিরের কোনো আয় নেই, নিজস্ব কোনো চা পাতার ফ্যাক্টরি নেই। এই বাগানের তহবিল জোগান ও আয়ের উৎসব বাড়াতে এবং চা শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য আমাদের এই উদ্যোগ।

তারাপুর চা বাগান শ্রমিকদের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি চৈতন্য মোদিও ম্যানেজারের সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, চা বাগানের কোনো আয় নেই। গত ৬ মাস থেকে শ্রমিকরা বেকার। তাই অনেক চিন্তা করলাম জায়গাটি অনেকে দখল করতে চায়। তাই কয়েকটি দোকান তৈরি করে ভাড়া দিলে আয় হবে। অগ্রিম টাকা বাবদও কিছু টাকা পাওয়া যাবে যা শ্রমিকদের উপকারে আসবে।

তারাপুর বাগানটি কিছু অংশ সিটি করপোরেশন এলাকায় পড়লেও বাকি অংশ পড়েছে শহরতলীর ৬ নম্বর টুকেরবাজার ইউনিয়নে আওতায়।

এ বিষয়ে টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সফিকুর রহমান সফিক বলেন, তারাপুর বাগান যখন রাগিব আলী চালাতেন তখন সেখানের শ্রমিকদের এক স্বর্ণযুগ ছিল। এরপর মামলার মাধ্যমে পঙ্কজ দায়িত্ব পেলেও এখন বাগান চালাচ্ছে কমিটি। কমিটির কাছে বাগান যাওয়ার পরে অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, লাখাউড়ায়ও প্রায় ৫২ কেদার জায়গা শ্রী শ্রী জিউর দেবতার নামে ভূমি দখল নিতে সাইনবোর্ড টানানো হয়। এখন চা বাগানের টিলা কেটে দোকান-কোটা হচ্ছে। তারা চাচ্ছে দেবতার নামে দোকান-কোটা নির্মাণ করে আয়ের টাকা দিয়ে শ্রমিক চালাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০২৪
এনইউ/এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।