ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যৌবন ফিরবে কাটাখালির, সৌন্দর্য বর্ধনে আসছে প্রকল্প 

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২৪
যৌবন ফিরবে কাটাখালির, সৌন্দর্য বর্ধনে আসছে প্রকল্প 

সিরাজগঞ্জ: বিস্তীর্ণ যমুনাপাড়ের শহর সিরাজগঞ্জের বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট নদী কাটাখালি। শহরকে দ্বিখণ্ডিত করা এ নদীকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে স্বপ্ন দেখেছেন শহরবাসী।

 

ছোট্ট নদীতে কুলকুল রবে প্রবাহিত হবে স্বচ্ছ পানি, ছিপ ফেলে বসে থাকা শৌখিন মাছ শিকারিদের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠবে স্বচ্ছ জলে, নদীতে চলবে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। বর্ষায় ফেঁপে ওঠা জলরাশিতে সাঁতার কাটবে শিশু-কিশোরের দল, দুপারের মেলবন্ধনের জন্য তৈরি হবে একাধিক দৃষ্টিনন্দন সেতু। বিকেল হলেই সেতুতে বসবে বিনোদনপ্রেমীদের হাট।

কাটাখালিকে ঘিরে এমন হাজারও স্বপ্ন দেখেছিলেন সিরাজগঞ্জের মানুষ। কিন্তু প্রভাবশালীদের দখল, কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা আর জনসচতেনতার অভাবে নদীটি আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়।
  
অবশেষে কাটাখালির সৌন্দর্য বর্ধন ও স্বচ্ছপানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে পৌরসভা। জার্মান দাতা সংস্থা কেএফডাব্লিউয়ের অর্থায়নে ‘শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে’ ১৪০ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় কাটাখালির সংস্কার ও সৌন্দর্য্য বর্ধন, তিনটি বড় সেতু নির্মাণ, তীর সংরক্ষণ বাঁধ ও ফুটপাত নির্মাণ হবে। এছাড়া শহরে বিভিন্ন মহল্লার রাস্তায় ৫৪টি মাস্টার ড্রেন, রাস্তা সংস্কার ও ফুটপাত নির্মাণ করা হবে।  

সিরাজগঞ্জ পৌর মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, কাটাখালির সৌন্দর্য বর্ধনসহ শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে জার্মান দাতা সংস্থা কেএফডাব্লিউয়ের প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। আগামী মাসে একনেকে উঠলেই প্রকল্পটি অনুমোদিত হবে।  

কাটাখালির ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ১৮০৩ সালে পাটের ব্যবসার জন্য বৃটিশ নীলকুঠিয়ালরা সিরাজগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে প্রবহমান বড়াল নামে অতিপ্রাচীন মরা খালটি খনন করে। তখন থেকে এটি কাটাখালি নামে পরিচিত। এর উভয়প্রান্ত যমুনার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এ জলাশয় দিয়ে নৌকা ও ছোট জাহাজে করে পাটসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করা হতো। ১৮৮২ সালে ইংরেজ মহুকুমা প্রশাসক (এসডিও) মি. বিটসন বেল শহরকে ওপর থেকে দেখার জন্য নির্মাণ করেন ৩০ ফুট উঁচু দৃষ্টিনন্দন একটি সেতু। বাংলার তৎকালীন ছোটলাট স্যার আলফ্রেড ইলিয়ট সাহেবের নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয় ইলিয়ট ব্রিজ। স্থানীয়রা এটিকে বড়পুল নামেই চেনেন। খুঁটিবিহীন ১৮০ ফুট লম্বা ও ১৬ ফুট চওড়া সেতুটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্টুয়ার্ড হার্টল্যান্ড নামে এক বৃটিশ প্রকৌশলীর পরিকল্পনায় নির্মিত এ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল সেই সময়ের ৪৫ হাজার টাকা।  

১৯৬২ সালে কাটাখালির বাঐতারা প্রান্তের স্লুইচ গেটের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। পরে যমুনায় বাঁধ দেওয়ার কারণে উত্তরের মুখটিও বন্ধ হয়। ফলে কাটাখালির পানি প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বাধাগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয় এটি, ছড়াত থাকে  দুর্গন্ধ। সেই সঙ্গে শুরু হয় দখল। বেশ কয়েকবার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে কাটাখালি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়। দখলমুক্ত করা গেলেও আবর্জনা মুক্ত হয়নি কাটাখালি।
 
২০১৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড এটি আবার করে বাঐতারা স্লুইচ গেটের মাধ্যমে যমুনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। ২০২১ সালের বর্ষা মৌসুমে স্লুইচ গেটটি খুলে দেওয়ায় কাটাখালিতে প্রবেশ করে যমুনার স্বচ্ছ পানি। তখন কাটাখালি দুর্গন্ধমুক্ত হয়। ফলে এ কাটাখালি নিয়ে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন শহরবাসী। কিন্তু কয়েক মাস পর আবার পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ময়লা ফেলার কারণে কাটাখালি আবার আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়।  

ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম, স্কুলশিক্ষক লোকমান হোসেন, সাংস্কৃতিক কর্মী সূর্যবারী, শহিদুল ইসলামসহ অনেকেই বলেন, সিরাজগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন যে কাটাখালি থাকবে দুর্গন্ধ, আবর্জনা আর দখলমুক্ত। এটি শহরের সৌন্দর্য বর্ধন করবে।  নদীতে স্বচ্ছ পানি থাকবে, থাকবে নৌকা, দুপাশে থাকবে বসার ব্যবস্থা। এর আগে দফায় দফায় কাটাখালি খনন ও দখলমুক্ত করার চেষ্টা করলেও সে চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি। আশা করছি এবার আমাদের স্বপ্ন সফল হবে।  

সিরাজগঞ্জ পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মো. রবিউল কবির বলেন, কেএফডাব্লিউয়ের প্রকল্পের আওতায় রেলগেট থেকে দত্তবাড়ী সেতু পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ, ইলিয়ট ব্রিজ থেকে দত্তবাড়ি ব্রিজ পর্যন্ত ওয়াকওয়ে নির্মাণ, দত্তবাড়ি ব্রিজ থেকে একডালা স্লুইচ গেট পর্যন্ত খালের উন্নয়ন, ফুটপাথ নির্মাণ, কাটাখালির পাড়ে বিভিন্ন স্থানে বসার আসন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া রায়পুর, মিরপুর ওয়াপদা ও জানপুর এলাকায় তিনটি বড় সেতু স্থাপন করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় শহরের বিভিন্ন মহল্লায় ড্রেন স্থাপন করা হবে, যাতে  জলাবদ্ধতা নিরসন হয়।  

সিরাজগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা বলেন, কাটাখালির সৌন্দর্য বর্ধনে ছয় বছর ধরে কাজ করছি। ছয় বছর আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ২২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় কাটাখালি খনন, তিনটি দৃষ্টিনন্দন সেতু ও আড়াই কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়। তারপরও অনেক কাজ বাকি থাকে। এরপর আমরা পাঁচ বছর ধরে লেগে ছিলাম। জার্মান দাতা সংস্থা কেএফডাব্লিউ পাঁচ বছর সার্ভে করার পর আমাদের এ প্রকল্পটি দিয়েছে।  

তিনি আরও বলেন, আমাদের জনগণকে সচেতন করতে হবে। কাটাখালির পাশের বাড়িগুলোতে যারা বসবাস করেন, তারা যাতে ময়লা আবর্জনা সেখানে না ফেলেন, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। তবেই এটির সৌন্দর্য রক্ষা করা সম্ভব।  

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২৪
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।