ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২, ১৩ মে ২০২৫, ১৫ জিলকদ ১৪৪৬

জাতীয়

ফসল বাঁচাতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ, প্রাণ যাচ্ছে শত প্রাণীর

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০২, মার্চ ৭, ২০২৫
ফসল বাঁচাতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ, প্রাণ যাচ্ছে শত প্রাণীর

সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ইঁদুরের উৎপাত থেকে ফসল রক্ষায় জমিতে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতছেন স্থানীয় কৃষকরা। সেই ফাঁদে পড়েই মরছে ফসল রক্ষাকারী ও ইঁদুরভোজী প্যাঁচা, শিয়াল, বেজি, সাপ, গুঁইসাপসহ বিভিন্ন প্রাণী।

এছাড়াও অসাবধানতাবশত ইঁদুর নিধনের এই মরণফাঁদে পড়ে কৃষকের প্রাণ যাওয়ার খবর নতুন নয়।  

একইভাবে পোল্ট্রি ফার্মের চারপাশে রাতে শিয়ালের উপদ্রব রোধে বৈদ্যুতিক ফাঁদ ব্যবহার করছেন খামারিরা। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পূর্বে এ ধরনের বৈদ্যুতিক ফাঁদের ব্যবহার তেমন না থাকলেও বর্তমানে জেলাজুড়ে বাড়ছে মরণঘাতী এই ফাঁদের ব্যবহার।

বংশীপুর-মুন্সিগঞ্জ সড়ক ধরে যেতে ধানখালিতে জমিতে ইঁদুর মারার বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাততে দেখা যায় এক কৃষককে। এই মৃত্যু ফাঁদ কেন দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইঁদুর নিধনে বিকল্প কিছুই কাজে আসে না, বাধ্য হয়েই দিচ্ছি।

শুধু মুন্সিগঞ্জের ধানখালী এলাকার কৃষকরা নয়, উপজেলা জুড়ে এই মরণ ফাঁদ দিয়ে ইঁদুর নিধনের চেষ্টা করছেন কৃষকরা।

এ বিষয়ে একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর আগাম বৃষ্টি হওয়ায় ধানের ক্ষেত সবুজে ছেয়ে গেছে। ভালো ফলনের প্রত্যাশা করছেন চাষীরা। কিন্তু হঠাৎ করে ইঁদুরের আক্রমণে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ইঁদুর ধান গাছ কেটে সাবাড় করছে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ায় বাধ্য হয়ে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ফাঁদ পাতছেন।  

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর কদমতলা এলাকায় বোরো ধান ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব ঠেকাতে পাতা বৈদ্যুতিক ফাঁদে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শোকর আলী গাজী (৫৮) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। শোকর আলী গাজী গ্রামের মৃত মোবারক গাজীর ছেলে।  
শুধু এই ঘটনাই নয়, মাঝে মধ্যেই শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ইঁদুর মারা বৈদ্যুতিক ফাঁদে মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কৃষকরা ধান, গম, সবজিসহ বিভিন্ন ক্ষেতে ইঁদুর ঠেকাতে গুনা তারে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে রাখছেন। তবে, অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ এই ফাঁদ বন্ধে সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে ইঁদুর মারার ফাঁদে মরছে মানুষসহ শত প্রাণী।

মুন্সিগঞ্জের ধানখালী এলাকার কৃষক প্রিয়জিত মন্ডল জানান, বিষটোপ, ইঁদুর নিধন ট্যাবলেট, পলিথিনের নিশানা আর কলাগাছ পুঁতেও কূলকিনারা না পেয়ে ‘বৈদ্যুতিক ফাঁদ’ দিয়ে ইঁদুর নিধনের চেষ্টা করছেন কৃষকরা।  

ওই কৃষক আরো জানান, তারা প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ করে ধান লাগিয়েছেন। পানির সংকট, সার-কীটনাশকের দাম বেশি। এর ওপর আবার ইঁদুরের উৎপাত। তাই বাধ্য হয়ে বৈদ্যুতিক ফাঁদ ব্যবহার করেন তারা।
স্থানীয়রা জানান, ঘেরের মাছ চুরি ঠেকানো, ঘেরের আইলের ফসল রক্ষা এবং কৃষি ক্ষেতের অন্যান্য ফসল রক্ষায় কৃষক জমির চারদিকে গুনা তার টানিয়ে তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেন। একটি তার মাটির খুব কাছাকাছি দেওয়া হয়, যাতে কোনো ইঁদুর ঢুকতে গেলে মারা যায়। আরেকটি তার ঝোলানো হয় কিছুটা ওপরে। সাধারণত বিদ্যুতের ফাঁদে কাউকে পাহারায় রাখতে হয়। কিংবা এমন কোনো চিহ্ন দিতে হয়, যা দেখে মানুষ বুঝতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাহারা বা চিহ্ন কোনো কিছুই থাকে না। এতে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি।

ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক ফাদের ব্যাপারে শ্যামনগর সরকারি মহসিন ডিগ্রি কলেজের কৃষি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. শেখ আফসার উদ্দিন জানান, ইঁদুরের উপদ্রব এড়াতে ফসলের মাঠে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দেওয়া কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। কেননা, ইঁদুরের ফাঁদ নিমিষেই মানুষের মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হতে পারে। তাই ইঁদুরের উপদ্রব এড়াতে বিকল্প উদ্যোগ নিয়ে কৃষকদের ফসলের মাঠে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন।

শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা জানান, বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতা একেবারেই অবৈধ। বৈদ্যুতিক ফাঁদ ব্যবহারে কৃষকের অনুমতি নেই। এর পরও নির্দেশনা উপেক্ষা করে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ এই ফাঁদ তৈরি করছে। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি জমি বোরো ইরি চাষাবাদের আওতায় এসেছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক বোরো ধানের ক্ষেত পরিদর্শন করে ইঁদুর নিধন বিষয়ে কৃষকদের নানা কৌশল বা পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। এতে চাষিরা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে কৃষকরা ভালো ফলন ঘরে তুলতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী।

ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সঞ্জিত কুমার মন্ডল বলেন, গুনা তার ঝুলিয়ে তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কোনো অনুমতি নেই। এটা আইনের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তিনি তার গ্রাহক সাধারণকে অবৈধ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে মাইকিং করে প্রচারের মাধ্যমে অনুরোধ করবেন বলে জানান।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)রনী খাতুন বলেন, বিষয়টি আমি জেনেছি। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এ ধরনের মরণ ফাঁদ তৈরি অত্যন্ত অনিরাপদ ও বিপজ্জনক। ইঁদুর নিধনের জন্য আরও কার্যকরী ও নিরাপদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা ও কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০২৫
এমআরএম
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।