খুলনা: পরিবারের অমতে বিয়ে হয়েছিল ইসমাইল হোসেন অভি ও সুরাইয়া আক্তার সীমার। কিছুদিন পরেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
ত্রিভূজ প্রেমের জেরে এই হত্যাকাণ্ডের এমন রহস্য উন্মোচন করেছে খুলনা মহানগর পুলিশ (কেএমপি)। সোমবার (১৭ মার্চ) দুপুরে কেএমপির সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এম শাকিলুজ্জামান।
তাজকীর আহমেদ নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ঝউডাঙ্গ এলাকার নওখোলা গ্রামের মুরাদ হোসেনের ছেলে। খুলনা ম্যানগ্রোভ ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা প্রাইম ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ঢাকার কলাবাগান এলাকার একটি বাড়ির কেয়াটেকারের দায়িত্বে ছিলেন। আর সীমা হলেন তাজকীরের দুসম্পর্কের চাচাতো ভাই এখলাছুর রহমান রনির শ্যালিকা।
ঘটনায় বিবরণে ডিসি এম শাকিলুজ্জামান জানান, গত ২২ ফেব্রুয়ারি আসিফ মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি খালিশপুর থানায় তার মামাতো ভাই তাজকীর আহমেদ নিখোঁজ হয়েছে মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডির পর এই ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পুলিশের একটি চৌকস তদন্ত টিম প্রস্তুত করা হয়। ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পারে, প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে প্রেমিকার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে তাজকীর তার চাচাতো ভাই রনির শ্যালিকা সীমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকা থেকে খুলনায় আসেন। জিডি হওয়ার আগের দিন তাজকীর ২১ ফেব্রুয়ারি খালিশপুর থানাধীন গোয়ালখালি এলাকায় তার মামাতো ভাই আসিফ মাহমুদের বাড়িতে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য আসেন এবং বাসাতে কিছু সময় থেকে প্রেমিকা সীমার সঙ্গে দেখা করতে বের হয়ে যান। কিন্তু তারপর থেকে তার হদিস মিলছিল না। পরে তাজকীরের বাবা মুরাদ হোসেন বাদী হয়ে এজাহারনামীয় পাঁচজনসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২-৩ জন আসামির বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করলে খালিশপুর থানায় সেটি মামলায় রূপ নেয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশ এজাহারনামীয় আসামি নগরীর খালিশপুরের নিউজপ্রিন্ট মিল এলাকার মো. জলিল হাওলাদারের মেয়ে সুরাইয়া আক্তার সীমা (২০), খালিশপুর হাউজিং এলাকার মিন্টু মিয়ার স্ত্রী লাবনী বেগম (৪২), একই এলাকার মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে শহিদুল ইসলাম সাহিদকে (২০) গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে।
মামলা তদন্তকালে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি খালিশপুর থানা পুলিশ খানজাহান আলী থানাধীন ভৈরব নদীর বালুর মাঠ ঘাটে বস্তাবন্দী একজন অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের মরদেহ পড়ে আছে বলে খবর পায়। পরে সেটি উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। এরপর স্বজনরা মর্গে উপস্থিত হয়ে মরদেহের শরীরে পরিহিত চেক শার্ট ও পরনের প্যান্ট দেখে এটি তাজকীর আহমেদ বলে শনাক্ত করেন। পুলিশ গ্রেপ্তার আসামিদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ, নিরবচ্ছিন্ন তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রযুক্তির সহযোগিতায় অল্প সময়ের মধ্যে মামলার রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়।
তদন্তে জানা যায়, এজাহারনামীয় ১নং আসামি ইসমাইল হোসেন অভির সঙ্গে তিন বছর পূর্বে পরিবারের অমতে বিয়ে হয় সীমার। পরে অল্পদিনের মধ্যে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায় এবং অভি দেশের বাইরে চলে যান। এই সুযোগে তাজকীর আহমেদের সঙ্গে সীমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডিভোর্সের ৭-৮ মাস পরে অভি দেশে ফিরে এসে প্রাক্তন স্ত্রী সীমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের মধ্যে পুনরায় সম্পর্ক তৈরি হয়। এসময় ত্রিভূজ প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়, আর এটা গোপন রাখতেন সীমা। তিনি একইসঙ্গে দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দুই প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক চলমান রাখেন। এদিকে অভি আর সীমার সম্পর্ক পুনর্স্থাপিত হওয়ার বিষয়টি তাদের উভয় পরিবারের লোকজন জানলেও তাজকীরের সঙ্গে প্রেমের বিষয়টি অপ্রকাশ্য থেকে যায়।
কিন্তু ঘটনাক্রমে সীমার সঙ্গে তাজকীরের প্রেমের সম্পর্কের কথা জেনে যান অভি। এ নিয়ে সীমা ও অভির মধ্যে ঝগড়া হতে থাকে। তাজকীরকে শায়েস্তা করার জন্য সীমার ব্যবহৃত গোপন মোবাইল ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাকে খুলনায় আসতে বলেন অভি। তাজকীর খুলনায় এলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অভি তার বন্ধুদের সহায়তায় তাকে অপহরণ করে নিজ বাসায় নিয়ে যান। পরে অভি ও তার চার বন্ধু মিলে তাজকীরকে হত্যা করেন।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, তাজকীরের হাত-পা বেঁধে মুখে স্কচটেপ পেঁচিয়ে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ও পুরুষাঙ্গে উপর্যুপরি আঘাত করে এবং গলায় রশি দিয়ে ফাঁস দিয়ে নৃশংসভাবে মৃত্যু নিশ্চিত করেন আসামিরা। পরে তারা চার বন্ধু মিলে ডাকবাংলা থেকে ১০০ টাকা দিয়ে বস্তা কিনে তাজকীরের মরদেহ বস্তায় ভরে ইজিবাইকে করে ভোর ৪/৫টার দিকে হার্ডবোর্ড খেয়াঘাটে নিয়ে যান। সেখান থেকে পূর্বে ভাড়া করে রাখা ট্রলারযোগে দৌলতপুর যাওয়ার দিকে নদীর মাঝখানে নিয়ে মরদেহ ফেলে দেওয়া হয়।
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে খালিশপুর থানা পুলিশ তাজকীর হত্যাকাণ্ডে সুরাইয়া আক্তার সীমা, লাবনী বেগম এবং শহীদুল ইসলাম সাহিদকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত খালিশপুর হাউজিং বাজার এলাকার মো. আনোয়ার হোসেনের ছেলে মশিউর রহমান জিতু (২৪), খালিশপুরের বিআইডিসি রোড এলাকার শহিদুল ইসলাম কাজীর ছেলে রিয়াদ কাজীকে (২২) গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তাদের পাঠানো হয় কারাগারে।
গ্রেপ্তার জিতু ও রিয়াদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের পর মরদেহ বহনের কাজে ব্যবহৃত ইজিবাইকের চালক শহিদুল ইসলাম সাহিদকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। থানার রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আরও কোনো মামলা আছে কি না তা যাচাই করা হচ্ছে। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারেও অভিযান অব্যাহত বলে জানান উপ-পুলিশ কমিশনার।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৫
এমআরএম/এইচএ/