৫ আগস্টের বিপ্লবের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কয়েকটি বিষয়ে একমত। তার মধ্যে অন্যতম হলো আবার আরেকটি এক এগারো আসতে দেয়া হবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, ‘আরেকটি এক এগারোর স্বপ্ন যদি কেউ দেখে থাকেন তাহলে তারা ভুল করছেন। ’ একই কথা বলেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘কেউ যদি আরেকটা এক এগারো আনতে চায় তাদেরকে প্রতিহত করা হবে। ’ অন্যদিকে এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘এক এগারো পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশের মানুষ দেখতে চায় না। ’ এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও এক এগারোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন একাধিবার।
রাজনীতিবিদদের মধ্যে যখন নতুন করে এক এগারো সৃষ্টির ষড়যন্ত্র রূখে দেয়ার প্রত্যয় ঠিক তখনই আড়ালে নতুন করে আরেকটি এক এগারোর নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা দৃশ্যমান। আর এই নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করছে একটি সুশীল গোষ্ঠী। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। যারা সবসময় বাংলাদেশে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। এই গোষ্ঠী বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বেসরকারি খাতকে পঙ্গু করার নিরন্তর চেষ্টায় লিপ্ত।
তারা বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদেরকে হয়রানি করার জন্য উস্কে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের দোসর এই গোষ্ঠী বিভিন্ন দুর্নীতির কল্পকাহিনী আবার নতুন করে প্রকাশ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং আগস্ট বিপ্লবের নায়কদের বিতর্কিত করার প্রয়াস এখন লক্ষণীয়। দেশে পরিকল্পিত ভাবে একটি বিশৃঙ্খলা পরিবেশ সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে একটি মহল। এরা সেই ষড়যন্ত্রকারী যারা ২০০৭ সালে এক এগারোর কুশীলব ছিলো। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ বাস্তবায়ণের জন্য, এই দেশকে ভারতের অনুগত রাষ্ট্র বানানোর জন্যই তারা এক এগারোর প্লট সাজিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ছিলো এক এগারোর সম্প্রসারিত রূপ। এক এগারোর ধারাবাহিকতা তারা বহাল রেখেছিল। এক এগারোতে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা বানায়োট মামলা করা হয়। মঈন-ফখরুদ্দিন সরকার এই মামলা করেছিল বেগম জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই মামলা অব্যাহত রাখে। ঐ হাস্যকর মামলায় বেগম জিয়াকে সাজা দেয়া হয়। দুই বছরের বেশী সময় অন্যায় ভাবে কারান্তরীণ রাখা হয় বিএনপির চেয়ারপারসনকে। এক এগারোর ষড়যন্ত্র ছিলো তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে হটিয়ে দেয়া। আওয়ামী লীগ সেই ধারা অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখল করে অব্যাহত রেখেছিল। এক এগারোর মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে নানা মামলায় প্রহসনের সাজা দেয়া হয়েছিল। এভাবেই গত ১৭ বছর দেশে বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে ভারতের আনুগত্য প্রতিপালনের সংস্কৃতি চালু করা হয়। এখনো এক এগারোর ধারা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা দৃশ্যমান। প্রথম আলো-ডেইলি স্টার আবারও ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। আর এই গোষ্ঠীকে প্রতিহত করাই এখন রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।
এখন এক এগারোর ষড়যন্ত্রকে অনুধাবন করতে গেলে আমাদের ২০০৭ সালের এক এগারো সময়কাল কার্যক্রমগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে। সেই সময় শুধুমাত্র রাজনীতিবিদদের হয়রানি এবং হেনস্থা করা হয়নি, রাজনীতিবিদের কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়নি, ব্যবসায়ীদেরকেও পঙ্গু করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায় যে, এক এগারোর সময় ৭৬২ টি ছোট বড় শিল্প উদ্যোক্তারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে হয়রানি মূলক মামলা করা হয়েছিল। প্রায় চার হাজার সাতশ ২৫ কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করা হয়েছিল বিভিন্ন ছোট বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছ থেকে। ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রকাশ করে তাদের সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। ব্যবসায়ীরা যেন ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে সেজন্য কুৎসিত কলঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল।
আর এই সমস্ত কিছুর মূল হোতা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদপত্র গোষ্ঠী প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার। তারা একের পর এক টার্গেট করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মনগড়া আপত্তিকর বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করা শুরু করে। এই সমস্ত খবর প্রকাশিত হবার পরপরই দুর্নীতি দমন কমিশন সেই সমস্ত খবরের সত্যতা যাচাই বাছাই না করে তা লুফে নেয়। এসব ভিত্তিতে মনগড়া তদন্ত করে। আর এই সমস্ত তদন্তের কথা বলে বিভিন্ন গোষ্ঠী ওই সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলোতে গিয়ে শুরু করে চাঁদাবাজি এবং অবৈধ ভাবে অর্থ আদায়। কর নেয়ার রাষ্ট্রীয় নিজস্ব একটি পদ্ধতি আছে। কিন্তু সেই পদ্ধতি উপেক্ষা করে এক এগারো কুশলীবরা চাঁদাবাজির নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে এবং সেই পদ্ধতি ছিল নিপীড়ন মূলক। এর ফলে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত মুখ থুবড়ে পড়েছিল। স্বনির্ভর বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় সৃষ্টি হয়েছিল বিশাল একটা প্রতিবন্ধকতা।
মূলত ভারত চায় না যে বাংলাদেশে বড় শিল্প বিনিয়োগ হোক। ব্যবসায়ীরা মাথা তুলে দাঁড়াক। কারণ বাংলাদেশের বেসরকারি খাত যদি সমৃদ্ধ হয়, তাহলে দেশও সমৃদ্ধ হবে। এজন্য এক এগারোতে রাজনীতিবিদের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও টার্গেট করা হয়েছিল। বেসরকারি খাতকে ধ্বংস করার মিশনের মূল হোতা ছিল প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গোষ্ঠী। সেই সময় একের পর এক বিভিন্ন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ উত্থাপন করে, ব্যবসায়ীদের সম্বন্ধে জনগণের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেই অবৈধ অন্ধকার সময়ে চার হাজার সাতশ ২৫ কোটি টাকা অবৈধ ভাবে আদায় করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই অবৈধ অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে অনেকে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। হাইকোর্টে দায়ের করা এই রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই ধরনের জরিমানা আদায় অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। অবৈধ ভাবে অর্জিত অর্থ গুলো সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরকে ফেরত দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ছিল এক এগারোর ধারাবাহিকতা। এ কারণে তারা সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের পরও ওই সমস্ত অর্থ ব্যবসায়ীদেরকে ফেরত দেয়নি। এই অবৈধ তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
আমরা যেমন ঋণ খেলাপিদের কথা বলছি, অর্থ পাচারের কথা বলছি, সাথে সাথে অন্যায় অযৌক্তিকভাবে ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় চাঁদাবাজি হয়েছে সেটি প্রতিরোধের জন্য কোন কথাবার্তা বলা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ আমলে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিলো। বিভিন্ন অজুহাতে জোর করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার সংস্কৃতিকে আওয়ামী লীগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসাবে এই সমস্ত অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ অবশ্যই বেসরকারি খাতের ভুক্তভোগীদেরকে ফিরিয়ে দেয়া দরকার।
এবার আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফিরে আসি। এখন রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের ক্ষেত্রে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গোষ্ঠীর কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করছে ভয়ে কিংবা তাদের অতীত অপকর্ম ঢাকতে। কিন্তু তারা ব্যবসায়ীদের চরিত্রহননের ক্ষেত্রে ঠিক এক এগারোর ফর্মুলাই বাস্তবায়ন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি যে বিভিন্ন ব্যবসা এবং শিল্প গোষ্ঠীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। তাদেরকে অন্যায়ভাবে নানা রকম হয়রানি করা হচ্ছে। এক এগারোর স্টাইলে কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তাদের বিদেশের অর্থের উৎস সন্ধান করছে। এমনকি সংবাদপত্রে প্রকাশিত অসত্য, ভিত্তিহীন রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্তের নামে এক ধরনের প্রহসন চলছে। আর এসব হচ্ছে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের তত্ত্বাবধানে। এরাই এক এগারোর আসল কুশীলব।
আমরা সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করেছি, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান এ রকম হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমরা জানি যে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। বেসরকারি খাতের কারণেই বাংলাদেশ আজ অর্থনীতির এই জায়গায় এসেছে। কাজেই বেসরকারি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা হল অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা। একটু গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এখন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে নোংরা খেলা চলছে তা আসলে বিরাজনীতিকরণের একটি অংশ। কারণ দেশে একটি নির্বাচনের পথে এগোতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো কয়েকটি ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ঐক্যমত্য অবস্থায় রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনর্বাসন করতে দেয়া হবে না। আর এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে দেশে যেমন গণতান্ত্রিক ধারা দরকার তেমনি অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার। কিন্তু যদি বেসরকারি খাতকে এভাবে হয়রানি করা হয়, বেসরকারি খাতের বিরুদ্ধে যদি এক এগারোর মতোই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে বেসরকারি খাত মুখ থুবড়ে পরবে। এমনিতেই ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন শিল্প কারখানায় অযৌক্তিকভাবে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান লুটপাট হচ্ছে। ফলে অনেক ব্যবসায়ী উদ্যম হারিয়ে ফেলছেন। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং বৈরী পরিবেশের কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। এরপরেও প্রধান উপদেষ্টার ঐকান্তিক চেষ্টায় যখন বাংলাদেশের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটা নতুন প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা হচ্ছে, তখনই প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গোষ্ঠী আবার বেসরকারি খাতের বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এর ফলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পরবে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ঘটবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। এরকম একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এক এগারোর পটভূমি তৈরি করে। সে রকম একটি পটভূমি তৈরি করার এখন নিভৃতে চেষ্টা চলছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আমি মনে করি যে, একদিকে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন এক এগারো প্রতিরোধের জন্য বদ্ধপরিকর ঠিক তেমনি তাদেরকে সুষ্ঠু ব্যবসায়ী বান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে যে, অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়লে আবার নতুন করে ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই সুযোগ সৃষ্টি করার জন্যই বিরাজনীতিকরণের মাস্টারমাইন্ড গোষ্ঠী এই কর্মকাণ্ডগুলো করছে বলেই অনেকের ধারণা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২৫
এসআই