দিনাজপুরের এক কৃষকের মৃত্যুতে তাকে ‘হিন্দু নেতা’ উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি বিবৃতি দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায়ের অপহরণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
এই হত্যাকাণ্ড একটি পদ্ধতিগত নির্যাতনের অংশ, যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিয়মিতভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে, অথচ পূর্ববর্তী এমন ঘটনার অপরাধীরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা এই ঘটনার নিন্দা জানাই এবং আবারও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, কোনো অজুহাত না দেখিয়ে বা বৈষম্য না করে সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়— বিশেষ করে হিন্দুদের— সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব।
তাছাড়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালও নিজের এক্স হ্যান্ডলে থেকে এই বার্তা শেয়ার করেন।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এমন বার্তার পর দেশটির সংবাদমাধ্যম গুলো এই ‘হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে তুলকালাম লাগিয়ে রেখেছে এবং যথারীতি অতিরঞ্জিত, একপেশে ও ধারণা নির্ভর খরব প্রকাশ করে চলেছে তারা।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, সংখ্যালঘুদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার যেন থামার নামই নেই পড়সি দেশে। দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় একজন হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে নির্মমভাবে নির্যাতন করে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভবেশ চন্দ্র নামে ওই ব্যক্তি এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের বিরল ইউনিটের সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
আর এপিবিএন বলছে, ভবেশ চন্দ্রকে অপহরণের পর পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। গোটা ঘটনায় উত্তেজনায় বাংলাদেশে নাকি নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
এছাড়া এনডিটিভি, দ্য হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ফাইনেন্সিয়াল এক্সপ্রেসের মত প্রায় সব শীর্ষ স্থানীয় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলোতে অধিকাংশ সময়ই বাংলদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে।
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে যা জানা গেছে
বাংলানিউজের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান ৫৫ বছর বয়স্ক ভবেশ চন্দ্র রায় বিরল উপজেলার শহরগ্রাম ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত তারকানন্দ রায়ের ছেলে। তিনি ছিলেন পেশায় একজন কৃষক।
বিরল উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুবল রায় জানান, নিহত ভবেশ চন্দ্র রায় ওই পরিষদের সহ-সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) রাতে বিকেলে স্থানীয় দুই যুবকসহ চারজন দুটি মোটরসাইকেলে করে ভবেশের বাড়িতে আসেন। এরপর বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ী বাজারে যাওয়ার কথা বলে ভবেশকে তাদের মোটরসাইকেলে তুলে নেন। এরপর রাতে পান–বিড়ি খেয়ে তার অসুস্থতার খবর পায় পরিবার। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের ছেলে স্বপন জানান, ঘটনার দিন বিকেলে তার বাবাকে চারজন মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যায়। পরে রাতে মোবাইলে জানানো হয় যে তার বাবা অসুস্থ। পরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। পারিবারিকভাবে আলোচনা করে কি করা যায় সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি আরও জানান, তার বাবার মৃত্যু অস্বাভাবিক। তবে এটি অসুস্থ হয়ে নাকি আঘাতের মাধ্যমে সেটি এখনো নিশ্চিত নন। তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, এমন কোন তথ্য প্রমাণ তাদের কাছে নেই।
এ বিষয়ে নিহত ভবেশের স্ত্রী স্বান্তনা রাণী জানান, রতন ও আতিকসহ আরও ৪ জনের সাথে তার স্বামী মোটরসাইকেলে যান। কিভাবে তার স্বামী মারা গেছে এখনো সঠিকভাবে বলতে পারছেন না তিনি। সুস্থ অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হলেও পরে তার অসুস্থতা ও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার মাসুদ রানা জানান, হাসপাতালে পৌঁছার আগেই ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে। তারপরও কর্তব্যরত চিকিৎসক ইজিসি করে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর সবুর জানান, নিহতের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মরদেহ ময়নাতদন্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।
এ ঘটনায় নিহত ভবেশ চন্দ্র রায়ের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কোন অভিযোগও দায়ের করা হয়নি।
সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দড়ি টানাটানি
এর আগে গত সপ্তাহে ভারতের মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় নতুন ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলাকালে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হুগলি জেলায় এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে আগুন লাগানো, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং রাস্তা অবরোধের ঘটনা ঘটে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার (১৬ এপ্রিল) কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ইমাম-মোয়াজ্জেম-বুদ্ধিজীবীদের সভায় এই সহিংসতার জন্য বাংলাদেশকে দোষারোপ করেন। তার দাবি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৈঠক করে চক্রান্ত করে সেখানে অশান্তি লাগিয়েছেন।
মমতার বক্তব্যে এভাবে বাংলাদেশকে জড়ানোর ভারতের চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশকে জড়ানোর যেকোনো চেষ্টাকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি। আমরা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দিনাজপুরের এক কৃষকের মৃত্যুকে কেন্দ্রকরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের সেই বাসি অভিযোগে অন্তর্বর্তী সরকারের মুণ্ডপাতে যেন এক হয়েছে ভারতীয় মিডিয়া।
বাংলাদেশ সম: ২১৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০২৫
এমআর/এমএম