ঢাকা, শনিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩২, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ২০ শাওয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পাঁচ বছর, নির্বাচন ও গণহত্যার বিচার

মাহমুদ হাসান  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৫
পাঁচ বছর, নির্বাচন ও গণহত্যার বিচার

ইদানীং একটি কথা বেশ চাউর হচ্ছে। বলা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক।

কেন বা কী প্রেক্ষাপটে এ কথা বলা হচ্ছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট  ব্যাখ্যা নেই। জাতির ওপর চেপে বসা ফ্যাসিস্ট শাসক গত বছরের আগস্টে পালিয়ে যাওয়ার পর এ সরকার ক্ষমতায় আসে। তারপর নানা রূপে, নানা ঢংয়ে ফ্যাসিস্টের ল্যাসপেন্সাররা অস্থির করে তুলেছিল দেশ ও সরকারকে। অনেকে ভুলে গেলেও কয়েকটি ঘটনা ছিল ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক।  

শুরুতেই ছিল পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও তার জের ধরে ডাকাতির ছদ্মবেশে পলাতক গোষ্ঠীর কিছু অংশের মাঠে নেমে আতঙ্ক তৈরি করা। একে একে আনসার বাহিনীর আন্দোলন, পাল্টাপাল্টি যান্ত্রিক ও প্যাডেল রিকশাচালকদের অবরোধ- সংগ্রাম। অটোপাসের দাবি নিয়ে সচিবালয়ে হামলা, প্রশাসনিক ক্যুর আগে বিচার বিভাগ থেকেও একটি অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের পরই শুরু হয় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের রাস্তা অবরোধ। এছাড়া গার্মেন্টস কর্মীদেরও নামানো হয়েছিল পরিস্থিতি ঘোলাটে করার পরিকল্পনা নিয়ে। এর মাঝে সরকারের কিছু উপদেষ্টার লাগামহীন ও ফ্যাসিস্টবান্ধব বক্তব্য নিয়ে গরম হয়েছে পরিস্থিতি। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্র-জনতা ও সরকারের ত্বরিত হস্তক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছে।  

কিন্তু ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত থেমে থাকেনি। পলাতক হয়ে প্রতিবেশী দেশকে ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার দেশকে অস্থির করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। এসবই জানা বা পুরনো ঘটনা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ লক্ষ্য কী, তা এখনো স্পষ্ট করেননি দায়িত্বশীলরা। জোর ও যৌক্তিক দাবি যেমন ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরদের বিচার করা, তেমনি দেশকে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিষয়টিও সর্বোচ্চ প্রায়োরিটিতে রাখার কথা বলা হচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি গঠনের পর সরকারের মাঝেও নির্বাচন নিয়ে কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বেশি সংস্কার চাইলে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, আর তাড়াতাড়ি ও কম সংস্কার চাইলে চলতি বছরেরর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। মূলত একথা বলে নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি পরীক্ষায় ফেলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।

প্রায় দেড় যুগের আওয়ামী স্বৈরশাসনে ভোটাধিকার বঞ্চিত দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের। একটি উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি বাছাইয়ের স্বপ্ন দেখছে সাধারণ মানুষ। তবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ কবে আসবে সেটি নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।  

সরকারের তরফ থেকে এতদিন বলা হয়েছিল ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোট হবে। তবে সম্প্রতি নির্বাচন পেছানোর কথা বলা হচ্ছে। এই দ্বিমুখী অবস্থান মানতে পারছে না রাজনৈতিক দলগুলো। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। তবে দু-চারটি দল প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ না করে ভোট করার বিরোধী। বিএনপিসহ ৫২টি দল চাচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায় তারা। তা না হলে এপ্রিলের শেষদিকে রাজপথে নামার কর্মসূচি দেওয়া হবে। এ নিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি ও তার মিত্রদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমও কথা বলেছেন বিএনপিসহ মিত্র রাজনৈতিক দলের নেতারা।  

গত তিনটি সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি। এ কারণে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখার জন্য উদগ্রীব দেশের মানুষ। কমপক্ষে দুই কোটি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না গত ১৬ বছর ধরে। তারা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখার পক্ষে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের বিজয়ী জেন-জি প্রজন্ম।  

এদিকে,সরকারের প্রায় আট মাস শেষ হতে চলছে, অথচ নির্বাচন নিয়ে কোনো কিছু দৃশ্যমান নয়। এ কারণে সন্দেহের মাত্রা আরও বাড়ছে। তবে সরকারের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ ও অনাস্থা যাতে তৈরি না হয়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে তাদের প্রস্তুতির কথা জানালেও সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে সরকারের কোনো সবুজ সংকেত পায়নি। প্রায় এক মাস আগে এ সংক্রান্ত একটি নথি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠালেও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি নির্বাচন কমিশনে। অর্থাৎ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনায় আসেনি চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত। অন্যদিকে গত সপ্তাহে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।

ক্ষমতার লড়াইয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনের দাবির বিষয়ে বক্তব্য বেশ ধোঁয়াশাপূর্ণ। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সংগঠকদের নিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নির্বাচনের পূর্বে হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার নিশ্চিত করতে চাইছে। এ দলটিকে অনেকেই ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। তবে ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজনের বিচারের বিষয়টি জনমনের অন্যতম দাবিও বটে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নিরপেক্ষতার পাশাপাশি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে শুরু থেকেই। এমতাবস্থায় পরাজিত ও পলাতক আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্টবিরোধী শক্তিসমূহ নির্বাচনে কী অবস্থায় দেখতে চায় তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দীর্ঘদিন বিদেশে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করেছেন তাদের অবস্থান। তিনি বলেছেন, আলোচনা ও ঐক্যের মাধ্যমে নির্বাচনী রোডম্যাপসহ সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। অর্থাৎ বিএনপি এখনই নির্বাচন চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে দলটির অভ্যন্তরে আরও একটি মতও কাজ করছে। জানা যায়, এই অংশটির মত হলো, মিত্র রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে রাজপথে কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করতে বাধ্য করা।

শেষ পর্যন্ত আশার কথাও আছে। ড. ইউনূসকে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতা রাখার কানাঘুষার বিষয়টি নিছকই একটি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি। প্রধান উপদেষ্টা নিজে কখনো বলেননি যে তিনি সময় চান বা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চান। উল্টো সংস্কার ঐকমত্য কমিশনকে বলেছেন ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে হবে’।

তবে ড. ইউনূসের সামনে কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে গণহত্যার অভিযোগে হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার আগে হবে না নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হবে। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হালের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি বার্তা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “যেদিন থেকে আমাদের আওয়ামীবিরোধী অবস্থান এবং কম্প্রোমাইজের রাজনীতির বিরোধিতাকে ‘শিষ্টাচার বহির্ভূত’ বলা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের মিছিল বড় হতে শুরু করেছে। ”

মাত্র আট মাসের মাথায় আওয়ামী লীগের মিছিল বড় হওয়া কাম্য কিনা- সে প্রশ্নের সম্মুখীন এখন সরকার, ড. ইউনূস ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৫
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।