ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

রাশিয়ার প্রায় ৮ হাজার মসজিদে খতমে তারাবি অনুষ্ঠিত হয়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৯ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
রাশিয়ার প্রায় ৮ হাজার মসজিদে খতমে তারাবি অনুষ্ঠিত হয়

ভলগা নদী পারের একদল মানুষ রমজান মাসের প্রথম দিনের সকালে রাস্তায় বের হয়ে আশ্চর্য হয়েছেন। সকাল বেলায়ই তাদেরকে রাস্তায় দেওয়া হয়েছে রঙিণ আর উজ্জ্বল মসজিদের ছবি সমেত বাক্স, যার ওপরে লেখা- ‘কল্যাণময় হোক রমজান।

এভাবেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়ার মুসলমানরা পবিত্র রমজান মাসকে তাদের ধর্মীয় চেতনার উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে। রাশিয়ায় যারা তুলনামূলক ধার্মিক তারা রমজানে অন্যদের ধর্মীয় জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে। রমজানকে কেন্দ্র করে তারা হারানো মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।

গতবারের মতো এবারের রমজানেও রাশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত সেন্ট পিটার্সবার্গসহ দেশটির উত্তরাঞ্চলের মুসলমানরা রোজা রাখছেন প্রায় ২২ ঘণ্টা করে। তবে এ সময় রাশিয়ার সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য নয়।

রাশিয়ায় ইসলামের আগমনের ইতিহাসে চোখ বুলালে আমরা দেখতে পাই, সামরিক বিজয়ের পথে সেখানে ইসলাম যায়নি। সেখানে ইসলাম প্রচারের সূচনাটা হয় ব্যবসা ও মুসলমানের সঙ্গে রাশিয়ানদের মেলামেশার পথ ধরে।

বর্তমান রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা মুসলিম বাহিনীর অভিযানে ইসলামের বিজয় হলেও তার প্রভাব রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে পড়েনি। কারণ, আবহমানকাল থেকেই মধ্য এশিয়ার জাতিগুলো স্বাধীনভাবে বসবাস করে আসছে। তবে হ্যাঁ, রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত অল্পসংখ্যক মুসলিম দেশ যেমন, চেচনিয়া এবং সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণকারী মুসলিম দেশ যেমন তাজিকিস্তান রুশদের মাঝে ইসলাম প্রচারে অল্প-বিস্তর ভূমিকা পালন করেছে।

কিন্তু রুশ কর্তৃপক্ষ তা সহজে মেনে নিতে পারেনি। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, যে রাশিয়াতে ১৯৩১ সালে মসজিদ ছিল ২৬২৭৯টি, সে রাশিয়াতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র Soviet Warnews -এর ভাষ্য অনুযায়ী পরে মুসল্লিদের জন্য উন্মুক্ত মসজিদ ছিল মাত্র ১৩১২টি। ১৯৬৪ সালে ফরাসি ভাষায় তাশখন্দ সম্পর্কিত একটি বুলেটিন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, কাজখস্তানসহ গোটা মধ্য-এশিয়ায় মসজিদের সংখ্যা মাত্র ২৫০টি।

সময় পাল্টেছে। রাশিয়ায় ধর্ম পরিপালনে এখন কিছুটা ছাড় থাকলেও এক সময় সময়, এ দ্বার ছিল একেবারেই রুদ্ধ। জাকাত প্রদান ছিল নিষিদ্ধ। হজ করাও ছিল অসম্ভব। ১৯৪৫ সালের পর হজের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত, এমনকি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত হজ পালনকারী ব্যক্তির সংখ্যা একশ’র বেশি ছিল না। আর রমজান মাসের রোজা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ না হলেও কার্যত নিষিদ্ধ ছিল।

রোজা রাখা ছিল অসম্ভব। অবশেষে কয়েকজন মুফতি মুসলমানদের এই ফতোয়া দিতে বাধ্য হন, তারা যেন তিন দিন রোজা রাখে, যাতে তিন দিন ত্রিশ দিনের স্থলাভিষিক্ত হয়। এই তিন দিন হলো রমজানের ১ম দিন, ১৫তম দিন এবং ৩০তম দিন। -সূত্র: আল-মুসলিমুনা ফিল ইত্তিহাদিস সুফিয়াতি: ২৭৬

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মুসলমানরা প্রকাশ্যে ধর্মকর্ম করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে মসজিদগুলো নামাজের জন্য খুলে দেওয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, রমজান মাসে ইফতারের সময় রুশ মুসলিমরা নির্ধারিত স্থানে একত্র হয় এবং দলবেঁধে নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করে।

প্রায় প্রতিটি মসজিদেই কোরআন খতম হয় এবং উৎসবমুখর পরিবেশে তারাবির নামাজ আদায় করে তারা। রুশ মুসলিমদের একটি উত্তম অভ্যাস হলো, তারা ইফতারের সময় একত্র হয় এবং তাদের ধর্মীয় গুরু বা আলেম সে সময় ধর্ম বিষয়ে তাদেরকে বিভিন্ন পরামর্শ দেন।

আলোচনা হয় ইসলামের বিধি-বিধানের নানা দিক নিয়ে। ওই সব আলোচনায় ঈমান, ইসলাম ও ধর্মীয় জীবনযাপন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। আলোচনা শেষে তিনি সবার কল্যাণে দোয়া করেন এবং উপস্থিত সবার হাতে তিনি ইফতার তুলে দেন।

 
মস্কো শহরে রমজান মাসের শেষ দশদিন স্বেচ্ছায় মুসলমানরা ইফতারের জন্য স্থাপিত বিশেষ তাঁবুতে যেয়ে ইফতারে অংশ নেন। মস্কোতে এই শিবিরের আয়োজন করেন রাশিয়ার মুফতি সভা। এখানে প্রতিদিন শত শত রোজাদার একসঙ্গে ইফতার করেন। এভাবে একসঙ্গে ইফতার করতে পেরে তারা অত্যন্ত আনন্দিত। তাদের মতে, আয়োজন তাদেরকে সুযোগ করে দেয় একসঙ্গে মিলিত হওয়ার, পরিচিত হওয়ার, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার, আল্লাহর হুকুম ও তার হাবিব হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.)-এর সুন্নত মানার মতো মহা গৌরবান্বিত ও শ্রেষ্ঠ কর্ম সম্পাদনের।

রাশিয়া মুফতি কাউন্সিলের সহ-সভাপতি মুফতি আব্বিয়াসভ এ বিষয়ে বলেন, রমজানের শেষ দশ দিন নানারকমের অনুষ্ঠান হবে। আমরা শিবিরের আয়োজন এ কারণে করি, যাতে মুসলমানেরা একে অপরকে ভালো করে জানতে পারেন। শিবিরের অনুষ্ঠান সূচির অন্যতম হলো, কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা হাফেজ বাছাই করা। প্রায় ৭ বছর ধরে মুফতি কাউন্সিল এ আয়োজন করে আসছে।

মুফতি আব্বিয়াসভ আরও বলেন, রাশিয়ার প্রায় ৮ হাজার মসজিদে খতমে তারাবি অনুষ্ঠিত হয়। তারাবি শেষে বিশ্বে শান্তির জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

এক কথায়, রাশিয়ার মুসলমানদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন তারা সুযোগ পাচ্ছেন অন্যদের কাছে বিশেষ করে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের কাছে নিজস্ব মুসলিম সংস্কৃতি প্রকাশের। এ লক্ষ্যে প্রকাশ করা হয়, ইংরেজি ও রুশ ভাষায় ছোট ছোট পুস্তিকা, প্রচার-পত্র।

সব মিলিয়ে বলা চলে, প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা ও প্রায় সুদীর্ঘ ২২ ঘণ্টা সিয়াম সাধনার পর একসঙ্গে ইফতারি করা ও পারস্পারিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে রমজানের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির অগ্রযাত্রা দিনে দিনে বেড়ে চলছে। রমজান যেন সত্যিই এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে রাশিয়ায় বসবাসরত বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের মুসলিমদের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার। কামনা করি এ ধারা চলতে থাকুক অনন্তকাল।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।