খুলনা: কৃষি-শিল্প-পাট ও পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক কমিটি আসন্ন বাজেটের মূল লক্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘কৃষি-শিল্প-পাট-সুন্দরবন ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায়’ বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে জানানো হয়েছে।
বুধবার (১৪ মে) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কৃষি-শিল্প-পাট ও পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সাধারণ সম্পাদক নারীনেত্রী সুতপা বেদজ্ঞ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এস এ রশীদ, মুনীর চৌধুরী সোহেল নাগরিক নেতা অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সিদ্দিকী, পরিবেশকর্মী মাহফুজুর রহমান মুকুল, যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার, এস এম চন্দন, কোহিনুর আক্তার কণা, কোষাধ্যক্ষ প্রাণীপেমী এস এম সোহরাব হোসেন, দপ্তর সম্পাদক আফজাল হোসেন রাজু, শ্রমিকনেতা মো. অলিয়ার রহমান, নিজাম উর রহমান লালু, মিজানুর রহমান বাবু, মতিয়ার রহমান, আবদুল করীম, সরদার আবু তাহের, সাংস্কৃতিককর্মী শরিফুল ইসলাম সেলিম, কবি সাইফুর মিনা, শ্রমিকনেতা আবদুর রাজ্জাক তালুকদার ও মো. আশরাফ হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে কৃষিখাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং টেকসই কৃষির উন্নয়নের ল বাজেটে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। এরসঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি ও প্রস্তাবনা উত্থাপন করছি।
আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে-
১. কমিউনিটি সিড ব্যাংক স্থাপন ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা।
২. নতুন চাহিদা নিরুপনের ভিত্তিতে বীজ উৎপাদন খামার ও ফসল সংরক্ষণাগার নির্মাণের জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা।
৩. কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তি স্থানান্তর, যন্ত্রপাতি আমদানি ও কৃষিপণ্যের ওপর শুল্ক রেয়াতের জন্য বাজেটে নির্দেশনা থাকা।
৪. জাতীয় বাজেটে কৃষকদের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, কৃষি ভর্তুকি বজায় রাখতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা।
৫. সহজ শর্তে এবং কম সুদে কৃষি ঋণ প্রদান করা, যাতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা তাদের চাষাবাদের খরচ বহন করতে পারে।
৬. রাসায়নিক সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সেগুলোর দাম কৃষকের নাগালের মধ্যে রাখা।
৭. খাল খনন করে কৃষির জন্য পানির রিজারভেশন বা সংরক্ষণার তৈরি। জমিতে সেচের সুবিধা বাড়ানো এবং জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। নদী-খাল ইজারা বন্ধ করে কৃষির জন্য উন্মুক্ত রাখা।
৮. বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। শষ্য বীমা চালু করা।
৯. জমির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য জৈব পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি, জমিতে সুষম সার ব্যবহার, শস্য পর্যায় নির্ধারণ করে সাথী ফসল চাষ, লাঙল ও চাষাবাদের সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার, পানি ব্যবস্থাপনার উন্নতি, আগাছা ও কীট পতঙ্গের সমন্বিত দমন, মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ভূমি ক্ষয়রোধ বিবেচনায় নিয়ে জমির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। কৃষিপণ্যের পুষ্টিমান ও খাদ্যমান রক্ষা করা।
১০. কৃষিজমি ও জলাভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার না হওয়ায়, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ শিল্পায়নের নামে কৃষিজমি ধ্বংস করা হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক জমির জোনিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কৃষকের জমির মালিকানা নিশ্চিতকরণে খোদ কৃষকের হাতে জমি ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ থাকতে হবে, ভূমি মালিকানার সীমা নির্ধারণ, ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশন করা।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২০ সালের ২ জুলাই সরকার একসঙ্গে খুলনার ৯টিসহ সারাদেশের ২৬টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করেছে। সরকার মিল বন্ধের দুইমাসের মধ্যে সব পাওনা পরিশোধের অঙ্গীকার করলেও অদ্যবধি অনেক শ্রমিক এরিয়ারসহ তাদের বকেয়া পাওনা পায়নি।
অন্যদিকে উৎপাদন বন্ধ থাকার পরেও দুর্নীতিবাজ বিজেএমসি ও মিলের ২৫১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী সবেতনে বহাল তবিয়তে আছেন। সরকার তাদের জন্য বছরে বেতন বাবদ প্রায় ১৪০ কোটি টাকা প্রদান করছে। বন্ধ হওয়ার সময় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাত্র ১২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের মাধ্যমে রাষ্ট্রয়ত্ব পাটকলের আধুনিকায়ন করা সম্ভব। সরকার তা না করে ৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে কারখানা বন্ধ করেছে। ২৫টি পাট কলের জায়গা-জমি-রাস্তা-গোডাউন-নদীরঘাট এবং যন্ত্রপাতির বাজারমূল্য প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান সময়ে ডলারের হিসেবে ১৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করলে পাটকলের আধুনিকায়ন করা সম্ভব।
২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট। এতে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পাটের ব্যবহার বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল। বর্তমান সময়ে ইন্টেরিম সরকার পরিবেশ রক্ষায় মনোযোগী হয়েছেন। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে দেশের মধ্যেই পাটের বাজার তৈরির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্প রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চালু করার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সরকারের নেই। বাজেটে বলা হয়েছে, পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবনে কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। আমরা জেনেছি বন্ধকৃত মিলসমূহ চীনা বিনিয়োগের জন্য চালুর ব্যাপারে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিচ্ছে। মন্ত্রণালয়, বিডা ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাট শিল্পকে আধুনিকায়ন করে, দুর্নীতিমুক্তভাবে এবং ব্যবস্থাপনার গুনগতমান উন্নত করে চালু করতে পারলে এ পাট শিল্প লাভজনক করা সম্ভব। ব্যাপক কর্মসংস্থান, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকরাও সম্ভব।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, প্রকৃতি-পরিবেশ ও সুন্দরবন বাংলাদেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতীয় বাজেটে এটি সবসময়ই অবহেলিত ছিল। দেশের মানুষের যুক্তি-আন্দোলন-সংগ্রাম উপেক্ষা করে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। বর্তমানে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুর্ণাঙ্গ উৎপাদনে নেই এবং কয়লা আমদানির সমস্যা ও পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে এটি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনাও নেই। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কয়লা সরবরাহের স্থিতিশীলতা, পরিবেশগত নীতিমালা ও সরকারের বিদ্যুৎখাতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন খরচ দেশের গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। শুধু তাই নয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বায়ুদূষণ ও নদীদূষণ করে চলেছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে নৌপরিবহন ও দুর্ঘটনার ঝুঁকিতো রয়েছেই। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত কোনোভাবেই আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে নয়। এজন্য এর বিকল্প এখন থেকেই ভাবতে হবে।
এমআরএম/জেএইচ