কন্যা প্রমিতির প্রথম বিদেশযাত্রা। ভ্রমণটা যেন তার জন্য সুন্দর, আনন্দময় হয় সেটা নিশ্চিত করতেই এতো নেট ঘাঁটাঘাঁটি।
অন্যদিকে মেঘালয় শব্দটা সংস্কৃত থেকে এসেছে। নামটির মানে মেঘের আলয়। পুরো অঞ্চলটাই পাহাড়ের অনেক উপরে। ঘন কালো মেঘ থাকলে চারপাশ নাকি এমনভাবে ঢেকে থাকে যে দিগন্তজুড়ে থাকা পাহাড়, ঝরনা, নদী কোনো কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না।

আমরা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তামাবিল সীমান্তে পৌঁছালাম। সেখানে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। সেদিন ছিল কোরবানির ঈদের পরের দিন। অসংখ্য মানুষ জড়ো হয়েছেন। কিন্তু ইমিগ্রেশনের কাজ চলছে কচ্ছপেরও কম গতিতে। এর পরের ঘটনা পুরোটাই ইতিহাস। কীভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচণ্ড গরমে দাঁড়িয়ে থেকে ঘামে ভিজে কোলের শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সী কয়েকশো অভুক্ত মানুষ দু’দেশের কাস্টমস পার হলাম তা নিয়ে লিখতে বসলে কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে। শুধু বলবো ঈদ বা অন্য ছুটির মৌসুমে তামাবিল সীমান্ত দিয়ে কোথাও না যাওয়াই ভালো।
ওপারে আমাদের জন্য ট্যুরিস্ট গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার রিসান অপেক্ষা করছিলেন। তিনিই পুরোটা সময় সব ঘুরিয়ে দেখাবেন। ভেবেছিলাম দুপুর ১২টার মধ্যেই ভারতে ঢুকে যাবো। সীমান্ত থেকেই বেড়ানো শুরু হবে। আধঘণ্টার মতো দূরত্বে রয়েছে ডাউকি নদী। এই নদীর বাংলাদেশ অংশ দেখতেই মানুষ সিলেট যায়। ডাউকি থেকে শিলং তিন ঘণ্টার দূরত্ব।
পথে রয়েছে অনেকগুলো ট্যুরিস্ট স্পট। সেগুলো দেখতে দেখতে আমরা বিকেলে শিলং পৌঁছাবো। কিন্তু ইমিগ্রেশন শেষ করতে করতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে যাওয়ায় সব প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে গেলো। ভাগ্য ভালো যে গাড়িটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। মেঘালয়ের পাহাড়ি রাস্তায় রাতে গাড়ি চালানো নিষেধ। আমরা দেরি না করে রওয়ানা হয়ে গেলাম। তখনো একশর বেশি মানুষের ইমিগ্রেশনশেষ হয়নি। অন্ধকার নামার পর তারা কী করবেন তা ভেবে খুব খারাপ লাগছিল।
প্যাঁচানো পাহাড়ি রাস্তা এঁকে-বেঁকে উপরের দিকে উঠে গেছে। আমাদের একপাশে গাছপালা আর পাহাড়ি ঢাল। কিছুদূর পর পর তার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনার পানি। অন্যপাশে কখনো দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের সারি, কখনো উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছে পাহাড়ী নদী। অন্ধকারে সবই আবছা দেখছিলাম। মাঝে মধ্যেই আমরা মেঘের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিলাম। তখন চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। যত উপরে উঠছি ঠাণ্ডা তত বাড়ছে।
বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে আছি! প্রায় দুই ঘণ্টা চলার পর জনমানবহীন একটা জায়গায় রাস্তার পাশের ছোট্ট দোকানে গাড়ি থামলো। সেখানে আমরা আলু পরোটা, ছোলা ভুনা আর চা খেলাম। দারুণ স্বাদ। হঠাৎ দোকানটির রান্নাঘরের দিকে চোখ গেলো। এত্ত পরিষ্কার! প্রত্যেকটা বাসন চক চক করছে। পুরো মেঘালয় ভ্রমণেই রান্নাঘরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মুগ্ধ করেছে। প্রতিদিনই রাস্তার পাশের ছোট দোকানগুলোতে খেয়েছি। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এক ফোঁটাও চিন্তা করিনি।
ভরপেট খেয়ে আমরা আবার রওয়ানা হলাম। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর প্রমিতির বমি ভাব শুরু হলো। পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা আর উঁচু-নিচু রাস্তায় তার পেট গুলাচ্ছে। শিলং শহরে ঢোকার একটু আগে বেচারার বমি হয়ে গেল। বমি পরিষ্কার করে, ওর জামা-কাপড় পাল্টে আমরা পরিশ্রান্ত, নোংরা তিনজন মানুষ রাত ১০টায় হোটেলে ঢুকলাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড!
হোটেল ম্যানেজার আমাদের দেখে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বিকেল পর্যন্ত আমাদের জন্য অপেক্ষা করে তারা রুমটা অন্যদের দিয়ে দিয়েছেন। তিনি খুব অস্থির হয়ে গেলেন। কেননা আজ সারা শহরে বাংলাদেশিদের ঢল নেমেছে, অন্য হোটেলে রুম পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমরা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তখন ম্যানেজারের মনে পড়লো হোটেলের এক কোণায় একটা ছোট রুম খালি আছে। একটু নিম্নমানের, তবে থাকা যাবে। আমরা খুশি মনে রাজি হয়ে গেলাম। আমরা যে অবশেষে শিলং পৌঁছে গেছি! এখন শুধু ‘নো ওয়ার্ক ডু ফূর্তি’-র পালা।
চলবে….
বাংলাদেশ সময়: ০৭০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৮
এএ