হা লং বে’তে তিন ধরনের জাহাজ বা ক্রুজ শিপে ভ্রমণ করা যায়। প্রথমত বড় অভিজাত ক্রুজ জাহাজ।


বাই চে পর্যটন হ্রদ বন্দর থেকে যেসব জাহাজ ছাড়ে, সেগুলো সাগরের মাঝে মোটামুটি তিনটি স্পটে নিয়ে যায়। যাত্রাপথে সাগরের বুকে একটি পাথর-সদৃশ দ্বীপ দেখা যায়, যেটিকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ডি লু হুরং। এই পাথরটি হা লং বে’র ট্যুরিস্ট আকর্ষণের জন্য ব্যবহৃত ব্র্যান্ডিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই দ্বীপের ছবি দেশটির দুই লাখ টাকা মানের কাগজের মুদ্রায়ও আছে। যাত্রার পুরোটা সময়ে লাইমস্টোনের এসব পাথুরে ছোট-বড় দ্বীপ আপনার পিছু ছাড়বে না এক মুহূর্তের জন্যও।

দ্বীপ ব্র্যান্ডিংয়ে ভিয়েতনাম সবচেয়ে যে দ্বীপটিকে ব্যবহার করে সেটি হচ্ছে ‘কিসিং চিকেন রক’। যদিও বিভিন্ন ট্রাভেল ব্লগ সাইটে এটিকে ‘কক ফাইটিং রক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন এটির নাম কিসিং চিকেন রক। দ্বীপটির ভেলকি হচ্ছে যে, দূর থেকে এটিকে দেখলে মনে হবে দুইটি মুরগীর ভালোবাসা বিনিময় চলছে। আবার মোরগ লড়াইও মনে হতে পারে। মজার বিষয় হচ্ছে, দ্বীপটিকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে ফিরে তাকালে এটিকেই আবার একটি মাছ মনে হবে। দ্বীপটির সঙ্গে পর্যটকদের ছবি তোলার জন্য প্রতিটি জাহাজ প্রায় ১০ মিনিট সাগরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। এটি ছাড়াও পুরো উপসাগরে এমন কিছু দ্বীপ আছে বা দ্বীপের মাঝে এমন কিছু পাথর আছে যা দূর থেকে দেখলে বিভিন্ন প্রাণীর মত দেখা যায়।

সারপ্রাইজিং কেভ-এ যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে ঘটে এক দুর্ঘটনা। ছবি তোলার জন্য পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করতেই বের হয়ে আসে আমার টিকিটও। মুহূর্তেই উড়ে গিয়ে বিলীন হয়ে যায় সাগরের বুকে। বন্দরে ফিরে আসার আগে আমি যে আর জাহাজ থেকে নামতে পারবো না, সেই কষ্ট বুঝি সংক্রমিত হয়েছিল অন্য যাত্রীদের মাঝেও। তবে সাহস জোগালেন গাইড হুই। দুশ্চিন্তা গোপন করে মুখে হাসি নিয়ে বললেন, আমি চেষ্টা করবো যেন তোমাকে সবগুলো স্পটেই নিতে পারি। মজা করে বললেন, তুমি প্রস্তুত থাকো এই জাহাজে এক মাস বাবুর্চির কাজের জন্য। বাংলাদেশে নাকি খাবারের স্বাদ খুব মজা? দেখাবে আমাদের!


সারপ্রাইজিং কেভ থেকে জাহাজে ফিরে এলে দেওয়া হবে দুপুরের খাবার। এসময়েই কিছুটা খেয়ে নিন। কারণ একটু পরেই কায়াকিংয়ের জন্য শক্তি দরকার হবে আপনার। দুইজনের প্ল্যাটিক কায়াকে করে বৈঠা দিয়ে ঘুরে বেড়াবেন সিক্রেট লেগুনে। হা লং বে’তে এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক সিক্রেট লেগুনের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে ধারণা করা হয়, এর সংখ্যা আরও থাকতে পারে। তেমনি এক ‘লুকিয়ে থাকা রত্ম’ লুয়ন কেভ হ্রদে কায়াকিংয়ের জন্য নামলাম আমরা। যারা কায়াকিং করতে চান না তাদের জন্য আছে মাঝিসহ নৌকার ব্যবস্থা। আমার ভ্রমণসঙ্গী সাগর সেই দলে যাওয়ায় কায়াকিংয়ে আমাকে জুটি বাঁধতে হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা তরুণী মার্সিয়ার সঙ্গে। পাহাড়ের নিচে গোপন সেই লেগুনে কায়াকিং করে যাওয়ার যে অভিজ্ঞতা তা শুধু কায়াকারই জানেন। ইচ্ছে হয় যেন, পরিষ্কার সবুজ পানিতে কায়াকের ওপর শুয়ে আকাশ দেখি।

কায়াকিংয়ের পর নিয়ে যাওয়া হবে তিতভ আইল্যান্ডে। সর্বশেষ এই গন্তব্যে যেতে যেতে জাহাজে বিশ্রাম হয়ে যাবে কায়াকিং করা নাবিকদের। উপকূল থেকে সাগরের গভীরে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরের এই তিতভ বা টিটপ আইল্যান্ড ভিয়েতনামের স্বাধীনতাযুদ্ধের এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী। এর নামকরণ হয়েছে বিখ্যাত রুশ মহাকাশচারী জার্মান স্টেপ্যানোভিচ তিতভ এর নামে। বলা হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের সময় এই দ্বীপে তিতভকে নিয়ে এসেছিলেন আংকেল হো বা হো চি মিন। ১৯৬২ সালে তাদের এই পরিদর্শনের পর থেকেই দ্বীপটির নাম রাখা হয় তিতভ বা টিটপ আইল্যান্ড।
প্রায় ৩৫০ বর্গমিটার দ্বীপটির ১১০ ফুট চূড়া থেকে সাগরের যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়, সেটির জন্য ভিয়েতনাম তো বটেই, গোটা বিশ্বের কাছে জনপ্রিয় তিতভ আইল্যান্ড। ৪০০-এর বেশি ধাপ পেরিয়ে ১১০ মিটার উঁচুতে উঠে আপনি যখন হাঁফ ছাড়তে ছাড়তে অপরূপ-মোহনীয় দৃশ্য দেখবেন, সেটি আপনার স্মৃতিতে রয়ে যাবে আজীবন। এই দৃশ্যের জন্যই ৪০০ ধাপ পাড়ি দিয়ে ফেলেন পর্যটকেরা।

বিকেলের খানিকবাদে অস্তমিত সূর্যের সঙ্গে বাড়ির পথে ফিরতে হয় আমাদেরও। পেছনে ফেলে যাই ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত হা লং বে’কে। ২০১১ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারকে হারিয়ে এটি জায়গা করে নেয় পৃথিবীর নতুন সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়। পৃথিবী তাকে কেনই বা এসব সম্মান দেবে না? প্রকৃতি যে তাকে দিয়েছে দু’হাত ভরে, সাজিয়েছে দারুণ রূপে।