ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বাদাবনের গহিন জীবনে

রাসেদ শাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০২৪
বাদাবনের গহিন জীবনে

নতুন পথের সন্ধানী এক ভ্রমণ-আয়োজক চরন্তি। ভ্রমণের দিকপিওন—এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই চরন্তির জন্ম।

শুরু থেকেই চরন্তি একদিকে যেমন ভ্রমণ বিষয়ক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে শুরু করেছে বিপুল আয়োজন; অপর দিকে দেশের অনাবিষ্কৃত নতুন ভ্রমণ পথের দিশা খুঁজে তার সৌন্দর্য ও রোমাঞ্চে ডুব দিতে সঙ্গী করছে অভিলাষী পর্যটকদের।

তারই ধারাবাহিকতায়, চরন্তি বছরব্যাপী আয়োজন করে যাচ্ছে নতুন ভ্রমণরুট ধরে নতুন সব সফর। চলনবিলের বিস্তৃত জলরাশিময় পথ ধরে একদা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাছারিতে আসতেন, গান-কবিতা-গল্প লিখতেন, সেই পথ ধরে ভ্রমণ হলো ‘রবি ঠাকুরের জলপথে’ নামে। এভাবে শুরু হলো সুন্দরবনের যে-পথ ধরে সাধারণত পর্যটকদের যাওয়া হয় না, সেই সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে নতুন রুটে ‘বাদাবনের গহিন জীবনে’ শিরোনামে রোমাঞ্চকর অভিযান; শীতকালে ‘উত্তরের শীতের গাঁয়ে’ শিরোনামে কুয়াশামাখা গ্রামের ভোর আর গৃহস্থের পিঠার নিমন্ত্রণ; ময়মনসিংহ অঞ্চলের পালানাট্য মহুয়া-মলুয়া-কাজলরেখার নদী-খাল-হাওরের পথ ধরে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা সফর’ অভিধায় পালাগানের সঙ্গে জলভ্রমণ।

‘বাদাবনের গহিন জীবনে’ প্রথম অভিযানের শুরু ২০২৩-এর ডিসেম্বরে। সেবার ২২ জন অতিথি নিয়ে সুন্দরবনের বড় নদী, অসংখ্য খাল, খাঁড়ি, ভাড়ানির জলপথ ধরে, সাগরের মোহনায় রূপমতি সব নির্জনদ্বীপে, ভয়ংকর জঙ্গলদ্বীপ আর সমুদ্র-সৈকতে কেটেছে রোমাঞ্চকর আনন্দঘন তিনটি দিন।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ঘাট থেকে রিজার্ভ বোটে শুরু হয়েছিল আমাদের যাত্রা। প্রথম দিনের গন্তব্য ছিল মান্দারবাড়িয়া। কদমতলা ফরেস্ট-অফিসে বনবিভাগের রাজস্ব পরিশোধ করে দুজন ফরেস্টার সঙ্গে নিয়ে মালঞ্চ নদী ধরে এগুতে থাকলাম। কথা ছিল দোবেকী বন-অফিসে যাত্রা বিরতি দেওয়ার। কিন্তু জোয়ার-ভাটা আর সময় বাঁচানোর কথা ভেবে আমরা সরাসরি মান্দারবাড়িয়ার পথ ধরলাম। প্রথমে পার হলাম মামুদা নদী। পথে পড়ল গোবরা খালি ভাড়ানি, তারপর নটাবেকি, পুষ্পকাটি, কাগা ইত্যাদি বন-কার্যালয়।  আড়পাঙ্গাশিয়া নদী পার হওয়ার পথে পেলাম কালিরচর। এই পথে বড় নদীতেই অধিক সময় ভাসলাম। এরই মাঝে অতিথিরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় সেরে নিয়েছে। গল্পে-আড্ডায় সবাই মিলে যেন হয়ে গেলাম একটি পরিবার।  সবচেয়ে আনন্দে ছিল আমাদের ক্ষুদে সহযাত্রীরা। পর্যটকশিশুদের জন্য আমরা অনেকগুলো বাঘের মুখোশ বানিয়ে নিয়েছিলাম, সেগুলি মুখে পরে তারা আমোদে মেতে ছিল।



সন্ধ্যা নাগাদ মান্দারবাড়িয়া বন-অফিসের ঘাটে ভিড়ল আমাদের বোট। কেউ কেউ বন-অফিসের চত্বরে কিছুদূর ঘোরাঘুরি করে বোটে ফিরে এল। বাকি সময়টা কাটল গল্পে, আড্ডায় আর এক সহযাত্রীর বাঁশির সুরে। ওই রাতে আর এক সহযাত্রীর জন্মদিনটাও উদযাপন করা হলো বোটে।

পরের দিন কুয়াশা মাখা ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি, যে-খালে বোট নোঙর করা সেখানে দুপাশ থেকে বনটা যেন আমাদের চেপে ধরতে চাইছে—  এতটাই সরু খাল। বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম সবাই। ধীরে ধীরে খাল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলাম মান্দারবাড়িয়া দ্বীপের সৈকতের দিকে। বড় বোট আটকে যেতে পারে তাই সৈকতের একেবারে কাছে যাওয়া গেল না। কিন্তু সকালের নরম রোদে সেই সফেদ বালুকাবেলা দেখে নামার ইচ্ছেটা কেউ আর দমিয়ে রাখতে পারল না। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নারী আর ক্ষুদে পর্যটকদের। অগত্যা কোমর পানিতেই নেমে পড়লাম সবাই। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোকে কেউ কাঁধে, কেউ কোলে করে নিয়ে পা রাখলাম সৈকতে। ক্ষুদে বন্ধুরা তখন কেউ ঝিনুক কুড়াতে, কেউ বল খেলাতে মেতে উঠল। সৈকতজুড়ে ছোটাছুটি আর পানিতে ঝাঁপাঝাপি করে বাঁধনহারা আনন্দে তারা বিভোর তখন। বড়দের কয়েকজন সৈকত লাগোয়া বনের ভেতরে কিছুটা যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বনরক্ষীদের বাধার মুখে বেশি দূর যেতে পারল না। কারণ মান্দারবাড়িয়া একসময়ে মানুষখেকো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য বিখ্যাত ছিল। শিকারি ও বনপ্রেমী ‘আক্তারুজ্জামান কামাল (বাঘমামা)’ তাঁর এক লেখায় এই দ্বীপকে ‘ল্যান্ড অব নো রিটার্ন’ নামে আখ্যা দিয়েছিলেন। এখনও নাকি এ-দ্বীপে মানুষখেকো বাঘেদের বিচরণ আছে!

মান্দারবাড়িয়া সৈকত ছেড়ে দুপুরের আগেই পৌঁছলাম পুটনি দ্বীপে। মালঞ্চ আর আড়পাঙ্গাশিয়া নদীর মোহনায় সাগরের বুকে অনাবিল সৌন্দর্যের একদ্বীপ, স্থানীয়রা বলে দ্বীপচর, আর জেলেদের কাছে এটির পরিচয় ‘বিবির মাইধে’ নামে। এই দ্বীপটি নিরাপদ, বাঘেদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। ত্রিকোণাকৃতির একটাদ্বীপ। পূবে হিরণ পয়েন্টের নীলকমল আর পশ্চিমে মান্দারবাড়িয়া। দক্ষিণে সাগরের দিকে মুখ করে বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা, অন্যপাশে ঘনজঙ্গল—গরান আর কেওড়ার বন; ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে ছোটোছোটো খাঁড়ি; হাঁটতে গেলে কাদাজলে পা ডুবে যায়; তাও আমাদের বিকার নেই। বুনো আদিমতায় আমরা যেন মন্ত্রমুগ্ধ। পুটনি দ্বীপের সৈকতে আর জঙ্গলে নির্বিঘ্নে কাটল অনেকটা সময়। বিকেলের মধ্যে পৌঁছতে হবে হিরণ পয়েন্টে। তাই মুগ্ধতায় রাশ টানতেই হলো।

পুটনি দ্বীপ থেকে আমরা যে-পথে হিরণ পয়েন্টের দিকে এগুলাম সচরাচর সে-পথে পর্যটকরা যায় না। এবারে পথে পেলাম কয়েকটা ছোটো খাল। সুন্দরবনে খাল, ভাড়ানির পথে গেলেই পাওয়া যায় সত্যিকার রোমাঞ্চের অনুভূতি। তখন ভাটা চলছে। শব্দ যাতে কম হয় তাই ইঞ্জিনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।  আমরাও খুব প্রয়োজন ছাড়া সাড়া শব্দ করছি না, কথা বললেও স্বর নিচু, পশুপাখি যেন বিরক্ত না হয়। কাদাখোঁচা পাখি, বক, বানর, হরিণের দল নির্ভয়ে যে যার মতো ব্যস্ত। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল বনের ভেতরে পাখিদের কলরব। বড়সড় একটা মদনটাক পাখি দেখলাম খাবারের খোঁজে শ্লথগতিতে পায়চারি করছে—যেন সে ধ্যানমগ্ন। আমাদের গতিবিধিতে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই! থাকবেই-বা কেন? জায়গাটা তো তাদেরই—আমরাই বরং সেখানে বহিরাগত।

দেখতে দেখতে বিকেলের মধ্যেই হিরণ পয়েন্টের জেটিতে ভিড়ল বোট। দূরে বড় জাহাজ, লঞ্চ নোঙর করেছে; ছোটো ডিঙিতে করে পর্যটকরা দলে দলে নামছে জেটিতে। এখানে পর্যটকদের সুবিধার্থে বনবিভাগ ভালোই নাগরিক সুযোগ সুবিধা রেখেছে—পাকাদালান, পাকারাস্তা এমনকি জঙ্গলে হাঁটার ট্রেইলটাও পাকা করে ফেলেছে। আরও কী সব নির্মাণ কাজ চলছে! কোনও আরণ্যকভাব নেই! বনে ও উন্নয়নের জোয়ার লেগেছে। ঘণ্টাখানেক ঘুরে ফিরে এলামবোটে। আজ হিরণ পয়েন্টেই রাত্রিযাপন। আয়োজন শুরু হলো বার-বি-কিউর। সঙ্গে আড্ডা, বাজছে বাঁশি।



শেষের দিন ছিল বিজয় দিবস, ১৬ ডিসেম্বর; সেদিন ভোরে পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাইল ছোটো-বড় সকলে। নৌকার মাথায় পতপত করে উড়ছিল জাতীয় পতাকা, আর নৌকা এগিয়ে চলছিল আড়পাঙ্গাশিয়া নদীর বুক চিরে জঙ্গলের গভীরে। চলতি পথে মাছ ধরায় মগ্ন জেলেদের সঙ্গে দেখা, আমাদের বোটে আমন্ত্রণ করে তাদের থেকে জেলেজীবনের গল্প, বনের অভিজ্ঞতা, আরও কত গল্প শোনা হলো।

শেষদিন রাতে অন্যতম আকর্ষণ ছিল—বনসংলগ্ন বনজীবী মুন্ডা আদিবাসী অধ্যুষিত কালিঞ্চি গ্রামে স্থানীয় পালাদলের আয়োজনে তাদের জীবনসংগ্রাম ও বিশ্বাসের প্রতীক ‘বনবিবির পালা’র পরিবেশনা। সেই পালা দেখতে দেখতে অতিথিরা হয়তো অনুভব করতে পারছিলেন—গত তিনদিনে দেখা সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যের বিপরীতে এর ওপর নির্ভরশীল এক জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার লড়াইটাও।

এভাবেই সুন্দরবনের গহিনে সবুজ প্রকৃতি, নিস্তব্ধতা, বিচিত্র ওয়াইল্ড লাইফ দর্শন আর বনবিবির পালা উপভোগে মন ভরে ছিল তিনটি পরিপূর্ণ দিন।

এবছর ২৮-৩০ নভেম্বর চরন্তির পক্ষ থেকে আবার হতে যাচ্ছে সুন্দরবন অভিযান। যারা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন, রহস্যের হাতছানি আর জঙ্গলের ভয়ংকর সৌন্দর্যে যারা হারাতে চান, দুর্লভ প্রাণিকূল আর ওয়াইল্ড-লাইফ ফটোগ্রাফি যাদের ভালোলাগা, কিংবা যারা দুটো-তিনটি দিন কেবলই নদী-খাল-ভাড়ানিতে ভেসে চলা বোটে শুয়ে-বসে গহিন জঙ্গলের সুনসান নীরবতা আর অফুরন্ত সবুজে ডুব দিতে চান—তাদেরই জন্য চরন্তির এই আয়োজন।

বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করতে পারেন মুঠোফোনে:
০১৯১১২৫০৬৩৭, ০১৭১৪০৯৬৩৬৯, ০১৭১৬৩২৩৭৮৭

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০২৪
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।