মস্কো বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন শেষ করে বাইরে দেখলাম ইংরেজিতে আমাদের নাম আর বড় হরফে বাংলাদেশ লিখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে আছেন।
ইংরেজি দেখে যতটুকু ভরসা হয়েছিলো প্ল্যাকার্ডধারীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ততটাই হতাশ হলাম।

স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমরা মস্কোর হোটেল গামায় পৌছলাম। প্ল্যাকার্ডধারী নিজেই ছিলেন গাড়িচালক।
পরিশ্রান্ত জার্নির পর রাতটা ছিলো ঘুমের। পরদিন সকাল ৭টায় নিচে নেমে দেখি জনা পঁচিশেক তরুণ-তরুণী। তাদের মধ্যে একজন রোসাটম নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম আমাদের জন্যই অপেক্ষা তাদের। কাছে যেতেই একটা ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিলেন, তাতে কলম, রাইটিং প্যাড আর ফাইনাল প্রোগ্রাম শিডিউল।

শুরু হলো গাইডেড যাত্রা। সবাইকে একটা বাসে উঠতে বলা হলো। বাসে উঠেই প্রোগ্রামটিতে চোখ বুলিয়ে নিলাম। আগত সাংবাদিকদের নাম এবং কে কোন দেশ থেকে এসেছে তারও উল্লেখ রয়েছে। জানা গেলো এই ট্যুরে তখন আমাদের সঙ্গী ইউক্রেন, চেক, বেলারুশ, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জর্ডান এবং আলজেরিয়ার তরুণ সাংবাদিকরা।

গাড়ি ছুটছে মস্কো শহর থেকে পূর্ব দিকে ৫৮ কিলোমিটার দূরের শহর এলেক্ট্রোস্টালে। সেখানে ভিভিইআর রিঅ্যাক্টর পরিদর্শনই শিডউল অনুযায়ী প্রথম কর্মসূচি।
সেখানে দেখানো হলো কিভাবে ইউরেনিয়াম ডাই অক্সাইডকে চাপ প্রয়োগ করে ফুয়েল প্লেটে পরিণত করা হয়। একে একে দেখানো হলো এই প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপ ফুয়েল এসেম্বল পর্যন্ত, কিভাবে কতখানি নিরাপত্তার সাথে কাজগুলো শেষ করা হয় তাও বর্ণনা করলেন সংশ্লিষ্টরা।

দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেলো। সেখান থেকে বের হয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। তারপর মস্কোতে ফিরে ক্রেমলিনের আশেপাশে খানিকটা ঘোরাঘুরি হলো। সেদিকটাতেই ডিনার শেষে হোটেলে ফিরলাম।
দ্বিতীয় দিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মেনেজে। এটি একটি প্রদর্শনী হল। রাশিয়ার পরমাণু শক্তির ৭০ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রদর্শনী চলছে। এক দোভাষী আমাদেরকে ইংরেজিতে বর্ণনা করে দিচ্ছিলেন প্রদর্শিত দলিল, দূর্লভ ছবি আর অস্ত্রের কথা। টানানো রয়েছে বিভিন্ন সময়ের খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী ও দেশরটির সমর নায়কদের ফটো। এ ছাড়াও সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে পরমাণু শক্তির সঙ্গে জড়িত বিশ্বের সব বিজ্ঞজনদের।

দুপুরের পর ক্রেমলিন ঢুকলাম আমরা। সেখানে পরমাণু শক্তির বিজ্ঞজনদের সম্মানে প্রথমে পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর প্যারেড প্রদর্শিত হলো এবং বিকেলে ছিলো ক্রেমলিন প্যালেসে এক পার্টি ও কনসার্টের আয়োজন। সেখানে দেখলাম তাদের, যাদের হাত ধরে পরমাণু শক্তি আজ এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও কি জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখ! চোয়ালে কি মনোবল এখনো! শক্ত করে ধরে রেখেছে বৃদ্ধ স্ত্রীর হাতটা, মনে হয় সেই প্রথম দিনের মতোই। সেদিন দারুণ এক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম হোটেলে।
শিডিউল অনুযায়ী পরদিন আমাদের শেষ পরিদর্শন। তাই একটু সকাল সকাল বের হতে হলো। গন্তব্য রাশিয়ার পরমাণু শক্তির জনক ইগর কুরচাতভের রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সেখানে দেখলাম সেই শুরুর দিককার রিঅ্যাক্টর, বিম প্রযুক্তি এমনকি কুরচাতভের সেই প্রথম রিঅ্যাক্টরটি যেখানে তিনি প্রথম এক মিলিগ্রাম প্লুটুনিয়াম তৈরি করেছিলেন। গ্রাফাইটের খাঁজের ছিদ্রে ইউরেনিয়াম ভরা সেই রিঅ্যাক্টরটি এখনো বেশ যত্নে রেখে দেওয়া হয়েছে, আর সেটি এখনো জীবন্ত!

পরে গেলাম কুরচাতভের জাদুঘরে। দেখলাম ব্যবহৃত জিনিসপত্র, চেয়ার-টেবিল, হাতের ছড়ি এমনকি পায়ের একপাটি চটিও কি স্বযত্নে রাখা। সেখানে রয়েছে রাশিয়ার পরমাণু শক্তিতে ভূমিকা রাখা আর সবার নাম ও ছবি। রয়েছে সে সময়কার ফুয়েল পেলেট থেকে শুরু করে তৎকালীন ফুয়েল এসেম্বলটি পর্যন্ত।

এরপরের গন্তব্য ন্যাশনাল রিসার্চ নিউক্লিয়ার ইউনিভার্সিটি (এমইপিএইচআই, প্রাক্তন নাম- মস্কো ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজিক্স ইনস্টিটিউট)। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা দেওয়া হলো। পরমাণু শক্তির বিভিন্ন শাখায় পড়ছে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছেন ২৩ জন। তাদের বেশীরভাগই পড়ছেন Nuclear power plants: design, operation and engineering বিষয়ে। কারণ আমাদের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনার দায়ভার অদূর ভবিষ্যতে তাদের কাঁধেই তুলে দেয়া হবে।

শিডিউল অনুযায়ী আমাদের ভ্রমণ শেষ। এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে বিরতি সেই ইস্তান্বুলেই। নেমেই দেখলাম অনেক বাংলাদেশি। ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর টার্কিশ এয়ারলাইন্সের বিমানের উঠলাম। লাস্যময়ী কেবিন ক্রুরা আমাদের সবাইকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তাদের চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি দেখেছিলাম যখন আমাদের সহযাত্রী বাংলাদেশীদের অনেকে প্লেনের এসির বাটন চালু করতে গিয়ে সিটের সাথের-উপরের, আশে-পাশের সবকটা বাটনে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ বাটনগুলোর একটি ছিলো কেবিন ক্রুদের দৃষ্টি আকর্ষণের। অনেকে একসাথে সেই বাটন চাপ দেয়াতে সবার কাছে যেতে তারা হিমশিম খাচ্ছিলেন, সেটাও সমস্যা ছিলো না, কিন্তু তারা বিরক্ত হচ্ছিলেন খানিকটা যখন শুনলেন এসি চালু করার জন্য তারা অজানা এক বাটনে একজনের পর একজন চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন।

খানিক পরে পরিস্থিত সামলেও নিয়েছিলেন তারা, হয়তো তারা এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এ রুটে সেবা দিতে গিয়ে। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের প্লেনটি ঢাকার রানওয়ে স্পর্শ করলো। সেপ্টেম্বর ২৭ এর ভোর পৌনে পাঁচটায়। লাগেজ পেতে পেতে ঢাকার আকাশে ভোরের সূর্য উঠে গেলো...
মস্কোর পথে ইস্তামবুলে দেখা
স্বপ্ন নিয়ে ছোটা বাংলাদেশি মধ্যবয়স্কা আর উগান্ডার তরুণ
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৫
এমএমকে