ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ চৈত্র ১৪৩১, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০২ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে দলগুলোতে নানা প্রশ্ন

স্পেশাল ও সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০২ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২৫
সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে দলগুলোতে নানা প্রশ্ন ফাইল ছবি

ঢাকা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের বিষয়ে যে সময়ের কথা বলছে তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন সম্ভব বলে কোনো কোনো দলের নেতারা মনে করছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে  বলেন, আমাদের দায়িত্ব, জাতির সামনে পুরো প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা এবং প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচনের বিষয়ে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।

কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য অস্পষ্ট, নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ নেই। নির্বাচন কেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে বলা হয়েছে, তা নিয়ে তাদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেন নির্বাচনের সময় ডিসেম্বর থেকে পিছিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত ছিল প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে। নির্বাচন নিয়ে এই দোলাচলের কারণ কী, তা নিয়েও এই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বিভিন্ন প্রশ্ন তুলছেন। এদের অনেকে মনে করছেন, সম্প্রতি নতুন যে রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে সে দলটিকে গুছিয়ে উঠতে সময় দিতে নির্বাচন দেরি হওয়া বা এ নিয়ে দোলাচল তৈরি করা হয়েছে। আবার প্রধান উপদেষ্টা যে সময়ের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছেন সেই সময়ের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচনের একটা সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। দেশের অধিকাংশ মানুষ নির্বাচন এ বছর (২০২৫) পার করতে চায় না। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে নতুন ধরনের বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে মানুষের মনে। নতুন যে দল গঠন হয়েছে সেই দলের বক্তব্য এবং সরকারের বক্তব্য একই ধরনের। অনেকে ধারণা করছেন, নতুন দলকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের অবস্থান হতে পারে। অথবা অন্য কোনো কৌশল বা উদ্দেশ্য আছে কিনা সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না, বুঝে উঠতে সময় লাগতে পারে। তবে নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণ করলে অপশক্তিগুলো অনেক ধরনের অপরতা চালানোর সুযোগ পাবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটলে নোবেলয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারা সরকারে এসে সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেয় এবং কমিশন গঠন করে। এসব কমিশনের মধ্যে কয়েকটি তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, আরও কিছু কমিশন কাজ করছে।

কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট সময় ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে না পারলে দেশে যে সংকটগুলো তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে তা আরও বাড়বে বলে এসব রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করেন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট ঘোষণা না দেওয়ায় এ নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে বলেও তারা জানান।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যে সংস্কার কার্যক্রমগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো সম্পন্ন না করে নির্বাচন দিলে উদ্দেশ্যটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিচ্ছে।  

কিছু রাজনৈতিক দল বলছে, অতি দ্রুত নির্বাচনের জন্য নির্বাচন সংক্রান্ত যে সংস্কারগুলো প্রয়োজনীয় সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে নির্বাচন দেওয়া দরকার। নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচনের যে প্রস্তুতির কথা বলেছে সেটিও রাজনৈতিক দলগুলো উল্লেখ করছে। এ বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব বলেও কোনো কোনো দল মনে করছে।

কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ না থাকায় নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ-সংশয় হচ্ছে বলছেন কেউ কেউ। আবার কারও কারও অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে নতুন যে রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছে সেই ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতিনিধিত্ব আছে, উপদেষ্টাও ছিলেন। নতুন দলটি যাতে রাজনৈতিকভাবে গুছিয়ে নিতে পারে, প্রস্তুতি নিতে পারে সে জন্যও নির্বাচন নিয়ে সময়ক্ষেপণ করার কৌশল থাকতে পারে। আবার অন্য কোনো উদ্দেশ্যও থাকতে পারে বলে কারও কারও ধারণা।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে একটা ধোঁয়াশা আছে। সরকার বলছে সংস্কারের ছোট প্যাকেজ হলে ডিসেম্বরে, আবার বড় প্যাকেজ হলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন। কিন্তু আসলে কোনোটাই স্পষ্ট করছে না। এতে ধোঁয়াশা ও সন্দেহ আরও বাড়ছে। নির্বাচন কবে হবে সেটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। নির্বাচন কমিশন তো বলেছে ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে তারা প্রস্তুত। আমরা তো মনে করি ডিসেম্বর লাগবে না, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও নির্বাচন করা সম্ভব। ইতোমধ্যে সাত মাস হতে চললো, অপরাধীদের বিচার, সংস্কারের জন্য মানুষ তো এ সরকারকে আজীবন সময় দেবে না। নির্বাচনের বিষয় স্পষ্ট না করার কারণটা অনেকে মনে করছেন, নতুন রাজনৈতিক দল যারা করেছেন তাদের মধ্যে থেকে সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। তাদের দল গোছানোর জন্য সময় দিতে দেরি করা হচ্ছে। তবে দেরি না করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। নির্বাচন যত দেরি হবে সংকট তত বাড়বে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যেটা বলেছেন এটা কূটনীতিপূর্ণ কথা। আর আমাদের দেশে জুন মাসে নির্বাচনের পরিবেশ থাকে না আবহাওয়াগত কারণে। বিভিন্ন কৌশলী কথার কারণে সরকারের নির্বাচন করার ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। ভিন্ন কৌশল বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এটা প্রকাশ্যে আসতে হয়তো একটু দেরি হবে। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে এত সময়ক্ষেপণ কেন? প্রথমেই তো রোডম্যাপ দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

নির্বাচনের জন্য কত সময় দরকার, কী বলছে ইসি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারপ্রধান ও তার দপ্তর থেকে ডিসেম্বর থেকে জুন, এরপর ডিসেম্বর, আবার ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছিল। ফের আবার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলায় নির্বাচন কমিশনও বুঝে ওঠতে পারছে না ঠিক কখন নির্বাচন হবে। তবে কমিশন বলছে, ২০২৫ এর এপ্রিলের পর নির্বাচন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেননা, এপ্রিলের পরেই বর্ষা চলে আসে পুরোদমে, যা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকে। এক্ষেত্রে নির্বাচন করতে হবে আরও পরে। অন্যদিকে জুনে স্কুলের পরীক্ষা থাকে, তাই সে সময় ভোটকেন্দ্র পাওয়া যাবে না।

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের তরফ থেকে যে টাইমফ্রেমের কথাই বলা হোক না কেন, কমিশন আগামী ডিসেম্বরকে টার্গেট করেই ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়ে ইসির প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। ইসি সচিব আখতার আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, সরকারের চিঠি আমরা পেয়েছি। দ্রুতই সবকিছু পর্যালোচনা করে আমাদের মতামত পঠিয়ে দেবো।

নির্বাচন কমিশনার আনেয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আমরা জুলাই-আগস্টের মধ্যেই ফুল প্রস্তুত থাকর চিন্তা করছি। কারণ আমাদের যে সংশোধনীগুলো আইনে আসছে সেগুলোর ম্যানুয়াল পাবলিশ করতে হবে। এই জিনিসগুলো আবার ডিস্ট্রিবিউট করতে হবে। তারপরে মাঠ পর্যায়ে থেকে সব পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এই যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, অক্টোবরে যদি আমরা তফসিল ঘোষণার চিন্তা করি তাহলে জুলাই-আগস্টের ভেতরে আমাদের সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা এগুচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী ডিসেম্বরকে টার্গেট করে সব ধরনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।

তিনি বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদে আমাদের যে টার্গেট, তা ফুলফিল হয়ে গিয়েছে এবং জুনের মধ্যে আমরা এটা চূড়ান্ত করতে পারবো। সীমানা পুর্ননির্ধারণ আইনে কিছু প্রিন্ট মিস্টেকসহ আমরা কিছু প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য। সেটার চূড়ান্ত কপি আমরা হাতে পাইনি। হয়তো এটি প্রক্রিয়াধীন। সংশোধনীটা হলে ডিলিমিটেশন (পুনর্নির্ধারণ) করতে পারবো। অন্যথায় যেভাবে আছে সেভাবে নির্বাচনটা করতে হবে। এটা আমাদের জুনের ভেতরে করার পরিকল্পনা। এছাড়া আমরা পোলিং পারসনদের যে প্যানেল সে প্যানেলটাও জুলাই-আগস্টের দিকে প্রস্তুত করে ফেলবো। রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডার যারা আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তাদের সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, সরকার থেকে ডিসেম্বর বা আগামী বছরের মধ্যে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। জুনে তো করা যাবে না। করলে হয়তো এপ্রিলে করতে হবে। জুনে বর্ষা থাকে। তবে আমরা মিনিমাম সময় ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। মিনিমান সংস্কার যদি হয় তবে ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে হবে। আর ডিসেম্বরে করতে হলে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২৫
এসকে/ইইউডি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।