ঢাকা, বুধবার, ১৯ চৈত্র ১৪৩১, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০৩ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে হামলার নেতৃত্বে সশস্ত্র আওয়ামী সমর্থকরা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২৫
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে হামলার নেতৃত্বে সশস্ত্র আওয়ামী সমর্থকরা প্রাণঘাতী অস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা | ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ‘আন্দোলন অব্যাহত থাকায় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে মিলে কিংবা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা এসব হামলার নেতৃত্ব দেন।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলা ও বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র আক্রমণের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা এই প্রতিবেদন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের সহজবোধ্যভাবে বোঝার সুযোগ করে দিতে অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সম্পাদকীয় বিভাগ ইংরেজি থেকে হুবহু বাংলায় অনুবাদ করেছে। বাংলায় অনূদিত সেই প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে পাঠকদের কাছে সংবাদ আকারে তুলে ধরা হচ্ছে। আজ থাকছে সেই প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব। এই পর্বে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে কিংবা সমন্বয় করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের জড়িত থাকার বিষয়টি থাকছে।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল তখন রাজনৈতিকভাবে নড়ে চড়ে বসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে এ আন্দোলন দমনের নির্দেশনা আসে দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর। একইসঙ্গে চলতে থাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে নিপীড়ন।

বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, রায়েরবাগ, খুলনা, কুমিল্লা ও সাভারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এইসব স্থানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা করেছে। আর এসব স্থানে হামলার ঘটনার সত্যতাও পেয়েছে জাতিসংঘ।

ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি রায়ে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করেন। আদালত ২০১৮ সালে সরকারের নেওয়া সেই সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। ওই সময়ে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের পর কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল।

শিক্ষার্থীরা কোটা ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কিছু সমর্থকও ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মতে, এটি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের অগ্রাধিকার দেয়, যা মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের নীতির পরিপন্থি। অনেক কোটা সুবিধাভোগী এমন পরিবার থেকে এসেছেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। ছাত্র আন্দোলনকারীদের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সরকারি চাকরির সুযোগ আমার জন্য নেই, কারণ আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। আমি শুধু গ্রামের একজন সাধারণ ছেলে। ”

ছাত্র আন্দোলনের মূলকারণ শুধু কোটা ব্যবস্থাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এর গভীরে ছিল বিগত সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বঞ্চনার বিরুদ্ধে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ। আন্দোলনের নেতা ও অংশগ্রহণকারীরা ওএইচসিএইচআরের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের ক্ষোভ দারুণভাবে উঠে আসে এক নারী আন্দোলনকারীর লেখা এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি গানে: “তেলা মাথায় দিচ্ছে তেল, দুর্নীতির কাছে সবই ফেল, ভালা মাইনসের কোনো ভাত নাই”। অল্পসময়ের মধ্যেই আন্দোলন সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিবাদে রূপ নেয়। অধিকাংশ বাংলাদেশিই এই আন্দোলনের সঙ্গে একমত ছিলেন এবং তারা মনে করতেন, দেশ ভুল পথে এগোচ্ছে।

প্রতিবাদ ঠেকাতে সরকার প্রাণঘাতী পথে ধাবিত হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার প্রতিবাদ আন্দোলন ঠেকাতে ধাপে ধাপে পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগতভাবে দমন পীড়ন বাড়িয়ে তোলে। প্রথমে ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা হলেও পরে ধীরে ধীরে আরও প্রাণঘাতী ও সামরিক কৌশলে দমন অভিযান চালানো হয়, যার ফলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।

এক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সমঅংশীদার হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়।

এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৪ জুলাইয়ের পরবর্তী দুই দিন ধরে এই হামলা অব্যাহত ছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার কাজটিও চালিয়ে যেতে থাকেন। ওএইচসিএইচআর জানতে পারে, এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ছিল নির্বিকার। একনেতা ওএইচসিএইচআরকে বলেন, “আমাদের (আওয়ামী লীগের) সাধারণ সম্পাদকের আহ্বানে মাঠে নেমে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ঠেকানোর কথা ছিল ছাত্রলীগ কর্মীদের। কিন্তু যা ঘটে তা অপ্রত্যাশিত ছিল, শিক্ষার্থীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। “

‘ছাত্রলীগ এককভাবে ক্রমবর্ধমান আন্দোলন দমন করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি অর্জনে ব্যর্থ হলে পুলিশ আরও বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয়। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর কম-মারাত্মক অস্ত্র যেমন টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করলেও কিছু ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী ধাতব গুলি ভর্তি বন্দুক ব্যবহার করে। অন্যদিকে, সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা পুলিশের সহায়তায় হামলা চালান। এসব হামলায় ১৬ জুলাই অন্তত ছয় জন নিহত হন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন (রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার হত্যার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে আরও বেশি শিক্ষার্থী, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দেন। ’

ব্যাপক বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে থেকেই সরকার আরও সামরিক কৌশল ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশকে সহায়তা করতে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়, যারা সামরিক অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলছিলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনে করতেন, “যদি আমরা আমাদের ‘হেভি ইউনিট’ মোতায়েন করি, তাহলে কেবল ‘জিহাদিরাই’ রাস্তায় থাকবে, আর অন্যরা ঘরে ফিরে যাবে। ”

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর জানায়, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিগত সরকার, সরকারের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীগুলো একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে আন্দোলন দমাতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন চালিয়েছে। প্রথম দিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলন দমনে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, সাউন্ড ও স্টান গ্রেনেড এবং ধাতব গুলিভর্তি শটগান ব্যবহার করে। এসব অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হুমকি হয়ে না দাঁড়ালেও শটগানের গুলিতে তাকে জীবন দিতে হয়। আন্দোলন আরও তীব্র হলে নিরাপত্তা বাহিনী আরও প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করে। তারা সামরিক রাইফেল ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ও পথচারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়, এর ফলে শত শত মানুষ নিহত হন।

আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের দায়ী করে প্রতিবেদনে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের লক্ষ্যে এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা ছাত্রলীগের সহিংস সদস্য ও সমর্থকদের সশস্ত্র হামলার উসকানি দেন। অনেক ক্ষেত্রে, এসব হামলায় অন্যান্য আওয়ামী লীগ সমর্থকেরাও যুক্ত ছিলেন। কর্তৃপক্ষ (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) তাদের বাধা না দিয়ে বরং দায়মুক্তির সুযোগ দিয়ে সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সরাসরি সাক্ষ্য, পাশাপাশি ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হতে পেরেছে, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি বড় অংশ পুলিশসহ সমন্বিতভাবে বা ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস হামলা চালিয়েছে। তারা ব্যাপক ও বেআইনি সহিংসতার মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে সরকারের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করেছে।

‘সশস্ত্র ছাত্রলীগ ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠিসোঁটা, দা ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, যা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের উসকানিতে ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে এসব হামলা পুলিশের সঙ্গে মিলিতভাবে করা হয়। ’

এসব হামলায় ও আক্রমনে যেসব আন্দোলনকারী আহত হয়েছিলেন, তাদের চিকিৎসায় সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও বাধা দিয়েছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। পরিকল্পিতভাবে দেওয়া এই বাধা আহতদের অবস্থা আরও গুরুতর করে এবং প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ছাত্রলীগের হামলার ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত যখন আন্দোলন মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কিংবা এর আশপাশে চলছিল, তখন ছাত্রলীগের সহিংস সদস্যরা কখনো নিজে, কখনো আওয়ামী লীগের অন্যান্য সমর্থকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিসোঁটা, ধারালো অস্ত্র এবং কিছু ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালায়। এই হামলাগুলো আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের উসকানিতে সংঘটিত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ১৪ থেকে ১৫ জুলাই রাতের মধ্যে ধারালো ও ভোঁতা অস্ত্রধারী কিছু আওয়ামী লীগ সমর্থককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয় এবং তারা ক্যাম্পাসের চারপাশে ভয়ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। প্রায় রাত ৩টার দিকে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন রাজু ভাস্কর্যে সমবেত আওয়ামী লীগ সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, “সোমবার (১৫ জুলাই) থেকে বাংলাদেশের রাস্তায় কোনো রাজাকার থাকবে না। এটি প্রতিটি জেলা, শহর, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতাদের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা— যারা অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়, যারা শহীদদের অবমাননা করবে, তাদের রাস্তায়ই প্রতিহত করা হবে। ”

১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিগত সরকারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “শিক্ষার্থীরা অহংকারী হয়ে উঠেছে। আমরা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। ” তিনি আরও বলেন, “কোটা সংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন নেতার বক্তব্যের জবাব দিতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজাকার স্লোগান দেওয়া আমাদের জাতীয় অনুভূতির প্রতি স্পষ্ট ঔদ্ধত্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যেকোনো অপশক্তিকে আমরা কঠোর হাতে প্রতিহত করব। ” এর আগেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী আন্দোলনকারীদের ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন এবং দাবি করেন, তাদের প্রতিবাদের কোনো অধিকার নেই। তখনকার প্রধানমন্ত্রী প্রথম এই শব্দ ব্যবহার করার পর, মন্ত্রীরা আরও সরাসরি ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকেন।

এ বিষয়ে কিছু মন্ত্রীর মুখোমুখি হয়েছিল জাতিসংঘের সংস্থাটি। প্রতিবেদনে সে বিষয়ে বলা হয়, ওএইচসিএইচআরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কিছু সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা (মন্ত্রী) দাবি করেন, এসব শুধুমাত্র ‘রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর’ ছিল। অন্যদিকে কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এসব মন্তব্য থেকে স্পষ্টভাবে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেন। মন্ত্রিসভার সাবেক এক সদস্য বিশেষভাবে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যকে ‘ভুল’ বলে স্বীকার করেন এবং বলেন, ‘এ ধরনের কথা বলা উচিত হয়নি’। ওএইচসিএইচআরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কোনো আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ নেতা বা মন্ত্রী এমন কোনো বক্তব্য বা নির্দেশনার কথা বলেননি, যেখানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এসব মন্তব্য থেকে সরে এসেছে বা বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তারা এটাও স্বীকার করেননি যে, ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সহিংসতা বন্ধের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিছু সাক্ষাৎকারদাতা স্বীকার করেছেন, আওয়ামী লীগ চাইলে সশস্ত্র সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত— যেমন দলীয় কার্যালয় রক্ষার জন্য তাদের মোতায়েন করা। তবে, দলটি কোথাও তাদের সমর্থকদের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানায়নি।

ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের সহিংসতা উসকে দেওয়া বক্তব্যের পরপরই ছাত্রলীগের সদস্য ও সমর্থকরা সরাসরি ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর একাধিক হামলা চালায়। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী হামলাকারীদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা বা সদস্যদের শনাক্ত করেছেন। হামলাকারীরা প্রায়ই ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কিত স্লোগান দিত। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, ভিডিও ও ছবি থেকে দেখা যায়, তারা অস্ত্র প্রদর্শন করেছিল, হেলমেট পরিহিত ছিল। তারা সংঘবদ্ধ কায়দায় সহিংসতা চালায়, যা ছাত্রলীগের আগের হামলার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এ বিষয়ে বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ওএইচসিএইচআরকে জানান, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সমর্থকদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম হয় এবং তারা সেসব অস্ত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ব্যবহার করে। বাংলাদেশ পুলিশ ওএইচসিএইচআরকে ৯৫ জনের নাম ও তাদের ভূমিকার তালিকা সরবরাহ করেছে। পুলিশ মনে করে, আন্দোলনের সময় সহিংস হামলা চালানোর জন্য তারা অস্ত্র সরবরাহ করে। এর মধ্যে ১০ জন তখনকার সংসদ সদস্য, ১৪ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ১৬ জন যুবলীগ নেতা, ১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা ও সাতজন পুলিশ সদস্য অন্তর্ভুক্ত। পুলিশ আরও ১৬০ জন আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তার নাম ও তাদের ভূমিকার তালিকা দেয়, যাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সহিংস হামলায় উসকানি দেওয়া বা নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মিলে এবং তাদের সহায়তায় আন্দোলন দমনে হামলা চালায়। কিছু হামলা পরিচালিত হয় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে, যার মধ্যে সংসদ সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য, ভিডিও ও অন্যান্য সূত্রের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রমাণ সংগ্রহ করেছে।

এই প্রতিবেদনে উপস্থাপিত সকল তথ্যের গভীর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর মনে করে যে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে সাবেক সরকার এবং তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সহযোগিতায় পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন চালিয়েছে। এসব আইন ভঙ্গের ঘটনা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নিরাপত্তা খাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, সমন্বয়ে ও নির্দেশনায় ঘটেছে।

প্রথম পর্ব
হেলিকপ্টার থেকে গুলি প্রসঙ্গে যা আছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে
দ্বিতীয় পর্ব
বিক্ষোভ দমনে গ্রেপ্তার, হত্যা, লাশ লুকানোর নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২৫
ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।