ঢাকা, শুক্রবার, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৬ মে ২০২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ছিন্নমূল-মাদকসেবীদের দখলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান 

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৪০, মে ১৫, ২০২৫
ছিন্নমূল-মাদকসেবীদের দখলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান  এই স্থানেই খুন হন ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য

ঢাকা: দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিন্নমূল ও মাদকসেবীদের আড্ডাখানা হয়ে উঠেছে। দিনে-রাতে সেখানে চলে মাদকসেবনসহ নানা অপরাধকর্ম।

শিক্ষার্থী সাম্য হত্যাকাণ্ডে নতুন করে আলোচনায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

মঙ্গলবার রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন।  

সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া এমনটি জানান। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকা অবৈধ দোকান উচ্ছেদ, মাদক কারবারি বন্ধ এবং পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে যৌথ অভিযান চালানো।  

আরও রয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পর্যাপ্ত আলো ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং সেগুলোর নিয়মিত মনিটরিং করা, উদ্যানে একটি ডেডিকেটেড পুলিশ বক্স স্থাপন করা এবং রাত ৮টার পর উদ্যানে জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা। বুধবার রাতে এসব সিদ্ধান্ত আসে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অতীত থেকে বর্তমান

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সাধারণ কোনো উদ্যান বা মাঠ নয়। ঢাকার কেন্দ্রস্থলে এই উদ্যানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কয়েকশ বছরের ইতিহাস। রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে এই উদ্যানটি এখন পরিচিত হলেও একাধিকবার এর নাম পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, এই উদ্যানের জন্ম হয় আসলে মুঘল আমলে।

উদ্যানে একসময় ঘোড়দৌড় হতো। এর নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। বাংলাদেশে সৃষ্টির ইতিহাসে রয়েছে এই উদ্যানের নাম। স্বাধীনতার পর স্থানটিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে নামকরণ করা হয়। ৬৩ একরের উদ্যানটি এখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতাধীন।

স্বাধীনতা স্তম্ভ, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে উদ্যানের ভেতরে। এই উদ্যানে যে কেউ যেকোনো সময়ে ঢুকতে এবং বের হতে পারেন। এর পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। ভেতরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা তেমন নেই। সারা দিনই ভিড় করেন মাদকসেবী ও কারবারিরা। আরও নানা অপরাধীদের আশ্রয়স্থল এই উদ্যান।  

যা দেখা গেল সরেজমিনে

বৃহস্পতিবার সকালে উদ্যানের মন্দির সংলগ্ন গেটে সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযান চলছে। এক্সক্যাভেটর, পে লোডার ও ডাম্পিং ট্রাক দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। উদ্যানে গড়ে ওঠা অবৈধ দোকান ভেঙে ফেলা হচ্ছে।  

অভিযানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন উদ্যানের গেট দিয়ে প্রবেশে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। গেটে কিছু সময় দাঁড়িয়ে দেখা যায়, লোকজন প্রবেশ করছে এবং বের হচ্ছে। তবে পরিবেশ ছিল কিছুটা থমথমে।  

কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাম্য হত্যার পর থেকেই উদ্যানের পরিবেশ স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা গোলমেলে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও ভবঘুরে ও মাদকসেবীদের আনাগোনা থেমে নেই। বহিরাগত লোকেদেরও অবাধ প্রবেশ চলছে।

উদ্যানে মাঝবয়সী এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের এই প্রতিবেদকের। ওই ব্যক্তি জানান, তিনি এসেছেন মাদক সেবন করার উদ্দেশ্যে। মাঝেমধ্যেই তিনি মাদকসেবন করতে আসেন। তার মতো অনেকেই আসেন। তার দাবি হলো, উদ্যানে মাদকসেবনে কোনো ঝামেলা হয় না।

উদ্যানের দেয়াল ঘেঁষে আছে বেশকিছু ময়লার স্তূপ, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। কাছেই থাকে অর্ধশতাধিক ছিন্নমূল পরিবার। এসব পরিবারের নারী ও শিশুদের অধিকাংশই সকাল থেকে বেরিয়ে যান বালতিতে ফুল নিয়ে। দিনভর কেনা-বেচা শেষে রাতে ফিরে আসেন তারা। রাতযাপন করেন খুপড়িতে।

কথা হয় সেখানকার এক ফুল বিক্রেতার সঙ্গে। নাম হনুফা বেগম। উদ্যানে আসা লোকেদের কাছে তিনি ফুল বিক্রি করেন। তিনি বলেন, এখানে আমাদের থাকতে তেমন বাধা নেই। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনো অনুষ্ঠান হলে কয়েকদিনের জন্য উদ্যান ছাড়তে হয়।

তিনি আরও বলেন, এখানে ফুল বিক্রিসহ অন্য কাজ করি আমরা তিন বোন। আমার মা এখানেই থাকতেন। তিনি বাড়ি চলে গেছেন। এখানে মাদকসেবীদের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খুন হয়েছে। এখন আমাদের মতো গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করছে সিটি করপোরেশন। দোষ করে একজন, প্রায়শ্চিত্ত করে আরেকজন।  

উদ্যানের চটপটি বিক্রেতা মো. দুলাল বলেন, ছাত্র (সাম্য) হত্যার আগেও দিনে-দুপুরে উদ্যানে মাদকসেবীদের অবাধ আড্ডা, উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের চলাফেরা ছিল। এখানে এসে ছাত্ররাও মাদক সেবন করত। এখনো উদ্যান এলাকায় অসংখ্য মাদকসেবী আছে।  

তিনি বলেন, মাদকসেবীদের না ধরে চালানো হচ্ছে হকার উচ্ছেদ অভিযান। আমাদের মতো গরিব মানুষের হয়তো দুই-তিন মাস কষ্টে চলবে। এরপর হয়তো আবার উদ্যানের দোকান নিয়ে বসতে পারব।  

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কী হয়েছিল সাম্যের সঙ্গে

নিহত ঢাবি শিক্ষার্থী বন্ধু বায়েজীদ জানান, মঙ্গলবার রাতে সাম্য, রাফিসহ তারা তিনজন একসঙ্গে মোটরসাইকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন রমনা কালীমন্দিরের গেট দিয়ে বের হচ্ছিলেন। তাদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে আরেকটি মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগে।  

ওই মোটরসাইকেলে থাকা চালক-আরোহী উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর আরও ১০-১২ জন চারটি মোটরসাইকেলে করে আসেন। সেখানে সাম্য ও তার বন্ধুদের সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে ওই দলের সবাই মিলে সাম্য ও তার বন্ধুদের মারধর শুরু করে। মারামারির মধ্যে এক ব্যক্তি ছুরি দিয়ে সাম্যকে আঘাত করেন। হামলায় সাম্যর দুই বন্ধু বায়েজীদ ও রাফি আহত হন।  

বায়েজিদ জানান, হামলাকারীদের কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নন। তাই তাদের কাউকেই চিহ্নিত করতে পারেননি তারা। কিন্তু একজনকে আটকে রাখা হয়েছিল। তাকে সেখানে উপস্থিত লোকদের হাতে তুলে দিয়ে তারা সাম্যকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মন্দির গেটসংলগ্ন ভেতরে ঘটনাস্থলে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। সেখানে দেখা যায়, উৎসুক শিক্ষার্থীরা সেখানে গিয়ে ভিড় করছেন। এ সময় ডিবি পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা স্থানটি পরিদর্শন করেন। পরদিনও পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

সাম্য হত্যাকাণ্ডে তার বড় ভাই শরীফুল ইসলাম শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়। পরে রাজধানীর রাজাবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন, মো. তামিম হাওলাদার, পলাশ সরদার ও সম্রাট মল্লিক। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

কী বলছে পুলিশ

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিষয়ে রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, এখানে ৪০ জন আনসার দায়িত্বে আছেন। আমরা এখানে মাঝে-মাঝে অভিযান চালাই, তাতে হচ্ছে না। আগামীতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করব। বহিরাগত লোকজন প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না এই উদ্যানে।  

ডিসি মাসুদ আরও বলেন, সাম্য হত্যায় তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের রিমান্ডে পাইনি। আজ রিমান্ডে পাব। তখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ঘটনাস্থল সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত নয়। এরপরও আশপাশের সিসি ক্যামেরার পর্যালোচনা করা হচ্ছে।  

বিশ্লেষকরা কী বলছেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি সচেতন নেতারা জানেন এই উদ্যানে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কী চলে। মাদক ও ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে এই উদ্যান। কাউকে মারধর বা নির্যাতন করার জন্যও এই উদ্যানকেই বেছে নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, যখন কোথাও মাদকের আখড়া গড়ে ওঠে, তখন মাদককে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। মাদক কারবারি ও সেবনকারীদের মাঝে নানা অবস্থানগত আধিপত্যের কারণে সংঘাত সহিংসতার সৃষ্টি হয়। সে সব সংঘাতে কখনো মাদক কারবারি, সেবনকারী বা মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ব্যক্তিকে কখনো কখনো জীবনও দিতে হয়। সাম্যর ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে কি না, সেটিও দেখতে হবে।

তৌহিদুল হক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কাজ করে। তারা কি কিছুই জানে না? এখানে সন্ধ্যার পরে কী হয়? বহু বছর ধরে এই উদ্যানটি মাদকের বাজারে পরিণত হয়েছে। সাম্যর প্রাণ গেছে বলেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিষয়টি সামনে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আর সক্রিয় দায়িত্ব পালন করতে হবে।

এমএমআই/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।