ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নাদিম হত্যা: আগে ওসির গাফিলতি, পরে এসপির দায়সারা বক্তব্য

সাগর ফরাজী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৯ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২৩
নাদিম হত্যা: আগে ওসির গাফিলতি, পরে এসপির দায়সারা বক্তব্য সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম: ফাইল ফটো

জামালপুর থেকে ফিরে: সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমকে তিন মাস আগে থেকে আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন নেতাসহ ছাত্রলীগের নেতারা হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১১ এপ্রিল রাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিনা বেগমের নির্দেশে তার ওপর হামলা হয়৷

এ ঘটনায় নাদিম বাদী হয়ে সাহিনা বেগমকে প্রধান করে বকশীগঞ্জ থানায় একটি অভিযোগ করেন।

কিন্তু সেই অভিযোগের গুরুত্বই দেননি বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল রানা। উল্টো জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও সাংবাদিকদের দিয়ে সমঝোতায় আসার চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।

নিহতের পরিবারের দাবি নাদিমকে সব দিক দিয়ে চাপ প্রয়োগ করা হলে তখন লাইভে এসে জীবনের নিরাপত্তার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করেন। কিন্তু থানার ওসি তার নিরাপত্তা না দিয়ে সমঝোতার কথা বলে সে সময় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। সাহিনা বেগমের হামলার ঘটনায় যারা ছিলেন এবারের হামলাকারীদের ভেতরেও তারা কয়েকজন ছিলেন। তখন যদি এ আসামিদের পুলিশ ধরতো নাদিম হয়তো হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন না।

নাদিম হত্যার পেছনে থানার ওসি সোহেল রানার এ অবহেলাকেই বেশি দায়ী করছেন পরিবারের স্বজনসহ স্থানীয়রা। অন্যদিকে নাদিমের মৃত্যুর পর জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ঘটনা ঘোরানোর মতো মন্তব্যের কারণ জানতে চেয়ে অধিকতর তদন্তের দাবি জানিয়েছে পরিবার। এছাড়া চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হলেও তার পুত্র রিফাত ও রাকিব গ্রেপ্তার না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে সাংবাদিক নাদিমের পরিবার।

নাদিম হত্যার পর দিন থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত জামালপুরের বকশীগঞ্জ থানা ঘটনাস্থল পাটহাটিয়া ও সাধুপাড়া পুলিশ ফাঁড়িসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে থানা পুলিশের সঙ্গে সাধুপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবুর গভীর সখ্যতার তথ্য পাওয়া গেছে।

বাবু কেন পুলিশের এত ঘনিষ্ঠ

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর চাচাতো ভাই মোখলেছুর রহমান পান্না অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন। সেই সূত্রে থানায় চেয়ারম্যানের প্রভাব ছিল অনেক। মোখলেছুর রহমান চাকরিতে থাকার সময় বাবু বাড়ির পাশে একটি পুলিশ ফাঁড়িও তৈরি করে নিয়েছিলেন। এছাড়া বাবুর বড় বোনের ছেলে রেজুয়ান দিপু সহকারী পুলিশ সুপার। বাবুর ছেলে পলাতক আসামি রিফাতের সঙ্গে তার একাধিক ছবিও রয়েছে।

সহকারী পুলিশ সুপার রেজুয়ান দিপুর সঙ্গে পলাতক ফাহিম ফয়সাল রিফাত

আরও জানা গেছে, গত দশ বছরে প্রায় ৫০ জনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিয়ে পুলিশের চাকরিও দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে বাবুর পুলিশ প্রশাসনে অনেক আত্মীয় থাকায় বকশিগঞ্জ থানার ওসি সোহেল রানা ও জামালপুরের এসপি নাছির উদ্দিনের সঙ্গে ছিল গভীর সম্পর্ক। তাই প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বাবু চেয়ারম্যান যা ইচ্ছা তা করতেন এলাকায়।

বাবুর এ ফাঁদ থেকে রেহাই পাননি এলাকায় অনুপস্থিত থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীও। ওই শিক্ষার্থী মাহমুদুল আলম বাবুর ভয়ে এলাকায় আসেন না। থানা পুলিশকে দিয়ে ধরপাকড় বাণিজ্য ছিল বাবুর আয়ের অন্যতম উৎস। স্থানীয় বিচার-সালিশে তার কথাই ছিল শেষ কথা। তাতেও চলত বাণিজ্য।
 

আওয়ামী লীগের উপজেলা সভাপতি সাহিনা বেগম

সাধুপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আক্কাস আলী বলেন, এ বাবু সাধুরপাড়ার একটি ডাকাত হয়ে গিয়েছিল। শুধু পুলিশের সম্পর্কের পরিচয়ে সাধুরপাড়ার মানুষ জিম্মি হয়ে গিয়েছিল। কেউ মুখ খুলতে পারত না৷ যে মুখ খুলেছে তারই কোনো না কোনোভাবে জেল খাটতে হয়েছে। নাদিম সাংবাদিক কথা বলছেন দেখে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
 

নাদিমের ওপর প্রথম হামলার পর পুলিশ কেন নীরব?

গত ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলা করা হয়েছিল। তখন একটি অভিযোগ করে নাদিম। পরে নাদিম বকশীগঞ্জ থানায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগম, আতাবুজ্জামান হেলাল, ইসমাইল হোসেন স্বপন, শামীম খন্দকার ও শেখ ফরিদসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন।

সে সময় নানাভাবে নাদিমকে চাপে রেখে বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হয়। পরে নাদিমের নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে একটি ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে দেন। সে ভিডিওতে নাদিম বলেন,‘আমি একজন সংবাদকর্মী হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের কাছে আমার জীবন ও আমার পরিবারের নিরাপত্তা চাই। আমি যেন সুষ্ঠুভাবে সাংবাদিকতা করতে পারি ও আমার জীবনের পরিপূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাই। ’

ওসি সোহেল রানা

নাদিম সে ভিডিওতে আরও বলেন, আমি অভিযোগ দিয়েছি ঠিকই কিন্তু অভিযোগ পুলিশ আমলে নেয় কি না জানা নেই। কারণ অভিযোগে যে প্রধান আসামি তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী লোক। অভিযোগ দেওয়া নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

এই ভিডিও ক্লিপ দেখার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের দিয়ে পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে নাদিমকে চাপ দিয়ে সমঝোতা করেন।

সাংবাদিক নাদিমের মেয়ে জান্নাত বলেন, আমার বাবার ওপর যখন আগে হামলা হয়, তখন জেলার নেতারা, পুলিশ ও সাংবাদিকরা মিলে চাপ দিয়ে সমঝোতায় আনা হয়। সত্য খবর প্রকাশ করার অপরাধে তাকে আজ সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। খুন হওয়ার আগে একাধিকবার হামলার শিকার হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওতে আকুতি করেন বাবা।

তিনি বলেন, পুলিশ কর্মকর্তারা যদি বিষয়টি আমলে নিতেন তাহলে আমার বাবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন না। পুলিশ প্রশাসন কোনো ধরনের আইনি সহায়তা দেয়নি। আমরা এখন মামলা করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাদেরও নিরাপত্তা প্রয়োজন।  

দ্বিতীয় হামলায় মৃত্যুর পরও এসপির বেফাঁস মন্তব্যে হত্যার মোড় ঘোরানোর চেষ্টা

নাদিম হত্যার ইস্যুতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে টকশোতে জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদকে খুনিদের পক্ষে কথা বলতেও দেখা গেছে৷ এসপি সে সময় বলেছেন, 'হামলার ফুটেজ দেখে আমার মনে হচ্ছিলো হত্যার উদ্দেশে সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলা করা হয়নি। মেরে ফেলার জন্য নয় আঘাতগুলো করা হয়েছিলো তাকে সতর্ক করা জন্য। অন্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। '

প্রশ্ন উঠেছে এসপি বা তার কর্মকর্তা কি নাদিমের হামলার কথা আগে থেকেই জানতেন? যদি না জানতেন তবে এসপি কীভাবে হত্যার উদ্দেশে হামলা হয়নি বিষয়টি এত নিশ্চিত হলেন? এ বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট এসপি এ হত্যাকাণ্ডটি সাধারণ মৃত্যু বলে হালকা করার চেষ্টা করেছেন?

এ বিষয়ে জামালপুরের কলামিস্ট এম. কে. দোলন বিশ্বাস বলেন, যদি সাংবাদিক নাদিমের জীবনের নিরাপত্তায় পুলিশ প্রশাসন আগে থেকেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতো, তাহলে সন্ত্রাসীদের হাতে আজ তাকে প্রাণ দিতো হতো না। নাদিমের জীবনের নিরাপত্তা না দেওয়ার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না এসপি নাসির উদ্দিন আহমেদ ও ওসি মো. সোহেল রানা।

এসপি নাছির উদ্দিন

এ মন্তব্যের বিষয়ে বাংলানিউজের প্রশ্নের জবাবে এসপি নাছির উদ্দিন আমতা আমতা করে বলেন, আসলে এটি সঠিক না। আমি যেটি বলেছিলাম। প্রথম আঘাত যেগুলো আমি দেখেছিলাম। লাইভ ছবিগুলো পাচ্ছিলাম। ওই আঘাতগুলো দেখে আমার মৃত্যুর উদ্দেশে আঘাত নয় এমন মনে হয়েছিল। পরে যখন জানতে পারি ইট দিয়ে মাথা থেঁতলানো হয়েছে। কিন্তু ব্লিডিং হয়নি। তখন মনে হয়েছে হত্যার উদ্দেশেই এ হামলা।

এর আগে ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর জামালপুরের সাংবাদিকদের পিটিয়ে শায়েস্তা করার হুমকিও দিয়েছিলেন এসপি নাছির উদ্দিন আহমেদ। এ নিয়ে সে সময় সাংবাদিকরা আন্দোলন করে তাকে জেলা থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
 

আসামি ধরাতেও পুলিশের ভূমিকা তেমন নেই, নিহতের পরিবার আতঙ্কে

ঘটনার দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও আসামি আটকে যায়নি পুলিশ। হত্যার খবর নিশ্চিত হয়েছ অভিযানের বের হয়ে কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। তবে এর মধ্যে পালিয়ে যায় প্রধান অভিযুক্ত বাবু। সে বাবুকে নাদিম হত্যার তৃতীয় দিনে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থেকে ধরে র‌্যাব। এছাড়া হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামিও আটক করে র‌্যাব। ২২ আসামির মধ্যে ১৩ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। চেয়ারম্যান পুত্র রিফাতসহ বাকি ৯ আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে পরিবারটি।

গত ১৪ জুন (বুধবার) রাত ১০টার দিকে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে জামালপুরের বকশীগঞ্জের পাথাটিয়ায় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথের সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন বাংলানিউজের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি গোলাম রাব্বানী নাদিম। স্থানীয় সাংবাদিক এবং পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে রাতেই জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর তার অবস্থার অবনতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) সকালে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যার ঘটনায় সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুকে প্রধান আসামি করে বকশীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন স্ত্রী মনিরা বেগম।

শনিবার (১৭ জুন) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বকশীগঞ্জ থানায় ইউপি চেয়ারম্যান বাবুকে প্রধান আসামি করে এবং ২২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ২৫ জনকে আসামি করে মামলাটি করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৯ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২৩
এনবি/এসএফ/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।