ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

অনলাইনে প্রতারণার ফাঁদ: হুন্ডিতে চীনে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা!  

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২৩
অনলাইনে প্রতারণার ফাঁদ: হুন্ডিতে চীনে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা!  

ঢাকা: অনলাইনে কাজ করার মাধ্যমে আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে যাচ্ছে চীনে পাচারের ঘটনা ঘটেছে।

এ ঘটনায় প্রতারকচক্রের দুই চীনা নাগরিকসহ দুই বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী আবুল কালাম আজাদ নামের এক সাবেক অতিরিক্ত সচিবের বর্ণনা মতে, ফেসবুকে অ্যামাজন কোম্পানির নাম ব্যবহারে বিজ্ঞাপন দেখেন তিনি। ওই বিজ্ঞাপনে অনলাইনে কাজ করার মাধ্যমে দিনে ২০০ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে ইচ্ছুকদের আবেদন করার আহ্বান জানানো হয়। দৈনিক গড়ে ১৫/২০ মিনিট কাজ করেই আয় সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়।  

গত ১৩ জুলাই ফেসবুকে এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে কৌতূহলবশত অ্যাপ্লা অনলাইন চিহ্নিত স্থানে ক্লিক করলে হোটাসঅ্যাপের মাধ্যমে একটি মোবাইল নম্বর থেকে সিকদার দিয়ানা (Sikder Diana - Daraz Amazon) নামধারী এক ব্যক্তির সঙ্গে স্বংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হয়ে যান ভুক্তভোগী আবুল কালাম আজাদ।  

হোয়াটসঅ্যাপে যুক্ত হওয়ার পরে কথোপকথনের এক পর্যায়ে অজ্ঞাতনামা ওই ব্যক্তি তাকে পার্টটাইম কাজের কথা বলে। প্রথমে ১ হাজার টাকা দিয়ে নিবন্ধন করার পর ধাপে ধাপে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে বিকাশ নাম্বারে মোট ৪৪ হাজার ৬১ টাকা এবং সিটি ব্যাংকের সিটিটাচ মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ৯৫ হাজার ৬৮৫ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর সিটি ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩৭ টাকা স্থানান্তরও করে অজ্ঞাতনামা প্রতারক চক্রটি।

শুধু তাই নয়, ভুক্তভোগী আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা মুনাফাসহ ফেরত দিতে ‘অগ্রিম কর’ হিসাবে আরও ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪০২ টাকা দাবি করে এই চক্রটি।  

ভুক্তভোগীকে বলা হয়, এই টাকা না দিলে তাকে কোনো প্রকার মুনাফা দেওয়া হবে না। ততক্ষণে ভুক্তভোগী আবুল কালাম আজাদ বুঝতে পারেন যে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

এরপর গত ১ আগস্ট রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি প্রতারণার মামলা (নম্বর-১) দায়ের করেন এই সাবেক অতিরিক্ত সচিব।

মামলা দায়েরের পর বিষয়টি তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগকে অবহিত করেন। এরপর ২ আগস্ট পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান চালিয়ে আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করে চট্টগ্রাম থেকে দেশি-বিদেশি প্রতারক এই চক্রের দুই চীনা নাগরিকসহ ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম।

গ্রেপ্তার প্রতারকচক্রের সদস্যরা হলেন- চীনা নাগরিক ক্যাং পিং (৪০), ঝ্যাং ইরউয়া (৩৮), তাদের সহযোগী সিয়াম চৌধুরী (২৪) ও মো. আবীর হোসেন (১৮)।  

অভিযানে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন কোম্পানির ১৫টি স্মার্ট মোবাইল ফোন, ৫টি বিভিন্ন কোম্পানির বাটন ফোন,  ১টি ল্যাপটপ, বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট সচলসহ ৩ হাজার পিস বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল সিমকার্ড, ১টি রাউটার ও ২টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটনের (ডিএমপি) ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রতারক চক্রটি অ্যামাজনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত ও নামিদামি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নাম, ছবি ব্যবহার করে চাকরিতে নিয়োগ ও অনলাইনে পার্টটাইম কাজ করার লোভনীয় টোপ দেয়। এভাবে ঘরে বসেই অনলাইনে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করা যায় বলে- চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেক মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর এসব টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চীনে পাচার করে আসছিল।

গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার ঝ্যাং পিং এবং ঝ্যাং ইরউয়া চীনের কুনমিংয়ের সিচুয়ানের জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া বসবাস করেন।  

এদিকে, বাংলাদেশে তাদের সহযোগী সিয়াম চৌধুরী (২৪) গাজীপুরের গাছা থানার বসুরা গ্রামের মো. রায়হান চৌধুরীর ছেলে এবং মো. আবীর হোসেন (১৮) গাজীপুরের গাছা থানার জাব্বার গ্রামের মো. আলমগীর হোসেনর ছেলে। তারাও ওই দুই চীনা নাগরিকের সঙ্গে সাতকানিয়া থাকতেন।

এ চক্রটির প্রতারণার যত কৌশল:

গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ জানায়, প্রতারণাকারী চক্রের হোতার নাম ডেং শোয়াইমিং। তিনি চায়নাতে বসে অ্যামাজনের নামের কাছাকাছি ডোমেইন (Amazon99.com, Amazon95s.com, Amazonos.com) কিনে বাংলাদেশের চক্রের সহযোগী সিয়াম ও আবীরের সহায়তায় অ্যাড বুস্টিং করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় এ চটকদার বিজ্ঞাপন দিতেন। সাধারণ মানুষ টাকা উপার্জন ও চাকরিতে নিয়োগের বিষয়টি বিশ্বাস করে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রদর্শিত হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, টেলিগ্রামের নানান চ্যানেলে ও লিংকে যুক্ত হয়। এই ডিজিটাল মাধ্যমগুলো চীন থেকে পরিচালনা করা হয়।

বিকাশ, নগদ ও ব্যাংকের মাধ্যমে ট্রানজেকশনের জন্য ১০-১৫ শতাংশ কমিশনের এবং ট্রানজেকশনের জন্য আরো বেশি কমিশনের প্রলোভন দেখাতেন চক্রটি। প্রথমে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০, ৫০০, ১০০০ টাকা পর্যন্ত ধাপে ধাপে লাখ টাকার ওপর ট্রানজেকশন করার নির্দেশনা আসতো।  

ছোট অঙ্কের লেনদেনগুলোতে লাভসহ আসল ফেরত পাওয়ায় সাধারণ মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়তে থাকে। এইভাবে ধাপে ধাপে গ্রাহকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে যখন গ্রাহক বড় অঙ্কের টাকা প্রদান করে তখন আরো টাকা লেনদেন করার জন্য নতুন নতুন শর্ত জুড়ে দেয়।  

নতুন শর্তসমূহ পূরণ না করলে গ্রাহকের দেওয়া টাকার মুনাফা বা মূলধন উত্তোলনে আর কোনো পথ থাকে না। এইভাবে একসময় বিভিন্ন কৌশলে নানান ডিজিটাল মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত মানুষের টাকা প্রতারকচক্র আত্মসাৎ করে থাকে। তাদেরকে সব ডিজিটাল মাধ্যম থেকে ব্লক করে দেয়।  

প্রতারকচক্র এই আত্মসাৎ কোটি কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চীনে পাচার করে দেশের অপূরনীয় ক্ষতি সাধন করছে।

যেভাবে প্রতারক হয়ে উঠে ওরা:

অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, গ্রেপ্তার আসামি ঝ্যাং পিং ও ঝ্যাং ইরউয়া প্রযুক্তিগত নানা দিক সমন্ধে অভিজ্ঞসম্পন্ন। এই চক্রের মূলহোতা ডেং শোয়াইমিং চায়নাতে বসে সব নিয়ন্ত্রণ করেন। ডেং শোয়াইমিং তার প্রতিনিধি হিসাবে চীনের এই দুইজন নাগরিককে প্রতারণার কাজের জন্য বাংলাদেশে পাঠায়। এই দুইজন চীনা নাগরিক বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশি আবীর হোসেন ও সিয়াম চৌধুরীর সঙ্গে অধিক টাকা উপার্জনের আশায় সখ্য গড়ে তুলেন। প্রযুক্তির নানান বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা থাকায় চীনা দুই নাগরিক দেশীয় দুই সদস্যের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে ডিজিটাল মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট খুলে অ্যামাজনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত ও নামিদামি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নাম, ছবি ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রতারণা শুরু করে। এইভাবে সহজেই মানুষকে ধোঁকা দিয়ে প্রতারক চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আবীর ও সিয়াম প্রতারণায় প্রাপ্ত অর্থ থেকে বেতন ও লভ্যাংশ পেত এবং বাকী সিংহভাগ টাকায় হুন্ডির মাধ্যমে চীনে পাচার করে দিতো।

অনলাইনে এমন প্রতারক চক্রের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে করণীয়-

অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন- অ্যামাজন, গুগল, ফেসবুকসহ বড় বড় কোম্পানির নামে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে বিভ্রান্ত না হওয়া। আইটসোর্সিংয়ের কাজের ক্ষেত্রে ডোমেইনের নাম এবং ইআরএল সঠিক আছে কিনা তা ভালোভাবে যাচাই করা। অপরিচিত হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টেলিগ্রাম, গ্রুপে নিজেকে যুক্ত করা হতে বিরত থাকা। অপরিচিত যেকোনো প্লাটফর্মে অতিরিক্ত লাভ অথবা কমিশনের লোভে যেখানে সেখানে টাকা বিনিয়োগ করা হতে বিরত থাকা। এই ধরনের সন্দেহজনক বিষয় দৃষ্টিগোচর হলে দ্রুত পুলিশকে অবহিত করা।

এদিকে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগী সাবেক অতিরিক্ত সচিব আবুল কালমা আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রতারক চক্র ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ট্রানজেকশনের মাধ্যমে আমার কাছ থেকে দফায় দফায় ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫৮৩ টাকা হাতিয়ে নেয়। যখন বুঝতে পারি আমি প্রতারিত হয়েছি, এরপর রমনা মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করি। গোয়েন্দা পুলিশ খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রতারকচক্রের আসামিদের গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। অনলাইনে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখে কেউ যাতে প্রতারিত না হন সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করছি।

বাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২৩
এসজেএ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।