ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

গাংনীতে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, বেড়েছে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২৪
গাংনীতে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, বেড়েছে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই

মেহেরপুর: গাংনী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক বোমা ও কাফনের কাপড় পাঠিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে চুরি ডাকাতি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে।

এসব চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ও বোমা উদ্ধারের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। ফলে জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।

পুলিশের পর্যাপ্ত টহল না থাকায় গাংনীতে চুরি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন এলাকাবাসী। তবে পুলিশ বলছে, কিছুদিন পুলিশি টহল নিষ্ক্রিয় থাকলেও এখন এলাকায় পুরোদমে কার্যক্রম চলছে।

জানা যায়, গত এক মাসে গাংনী উপজেলার পৃথক পৃথক চারটি বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হাত বোমা, কাফনের কাপড়, সাবান, আগরবাতি ও হুমকি সংবলিত চিরকুট রেখেছে দুর্বৃত্তরা। একটি বাড়িতে বোমার বিস্ফোরণও ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এছাড়া গত দুই মাসে প্রায় ১০টিরও বেশি চুরি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

সোমবার (২৮ অক্টোবর) সকালের দিকে গাংনী পৌরসভার চৌগাছা গ্রামে বস্তা ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনের বাড়ির গেট থেকে লাল স্কচটেপ মোড়ানো দুটি হাত বোমা, এক টুকরো কাফনের কাপড় এবং প্রাণনাশের হুমকি সম্বলিত একটি চিরকুট উদ্ধার করেছে গাংনী থানা পুলিশ।

ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন জানান, সকালে বাড়ির প্রধান ফটকে লাল স্কচটেপ মোড়ানো দুটি হাতবোমা, এক টুকরো কাফনের কাপড় ও হাতে লেখা প্রাণনাশের হুমকি সম্বলিত একটি চিরকুট দেখতে পান। চিরকুটে দুটি মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে যোগাযোগের জন্য। অন্যথায় গুলি করে হত্যা করা হবে বলেও চিরকুটে লেখা হয়। এতে তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এর আগেও হাতবোমা রেখেছিল দুর্বৃত্তরা।

এর আগে মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে গাংনী উপজেলার কড়ইগাছি গ্রামের স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিক লীগের রাইপুর ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন আলীর বাড়ির হ্যাসেল ঘরের সামনে থেকে দুটি হাতবোমা, কাফনের কাপড়, সাবান ও আগরবাতি ও দুই পাতার একটি চিরকুট রেখেছিল দুর্বৃত্তরা। পরে গাংনী থানা পুলিশকে খবর দিলে সেগুলো উদ্ধার করে থানায় নেন।  

গত ৩০ আগস্ট রাত ১০টার দিকে গাংনী পৌর শহরের চৌগাছা গ্রামের স্থানীয় বিএনপি কর্মী ও ওষুধ ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম মিঠুর বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে থেকে একটি হাত বোমা, এক টুকরো কাফনের কাপড় ও হত্যা সংবলিত হুমকির চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছিল। তার তিন দিন আগে ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে তার বাড়িতে বোমা হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় ওষুধ ব্যবসায়ী মিঠু ও তার পরিবার আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে দুষ্কৃতিকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

এছাড়া গত ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে গাংনী উপজেলার গোপালগর বাজারে রাইপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে দুইটি হাতবোমা, চিরকুট ও একটু টুকরো কাফনের কাপড় উদ্ধার করে পুলিশ।  

বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম জানান, আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে বোমা, কাফনের কাপড় ও চিরকুট উদ্ধারের ঘটনায় আমি ও আমার পরিবারের লোকজন এখনও আতঙ্কিত।

গত ৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাতে মেহেরপুর—কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের গাংনী উপজেলার আকুবপুর নামক স্থানে গাছ ফেলে প্রায় ঘণ্টা ধরে গণডাকাতি করে ডাকাতরা। এসময় দূরপাল্লার শ্যামলী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসসহ বেশ কয়েকটি যানবাহনে গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা পথচারী, যাত্রী ও কয়েকজন পরিবহন চালককে কুপিয়ে জখমের পাশাপাশি মারধর করে স্বর্ণালংকার ও অর্থ লুট করেছে। ডাকাতদের হামলায় যাত্রীবাহী যানবাহনের চালক, তার সহকারীসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তারা হলেন- শ্যামলী পরিবহনের চালক মোস্তাফিজুর রহমান (৫০) ও তার সহকারী রহিদুল ইসলাম (৩৩)।

আহতরা জানান, ২০ থেকে ২২ জনের একটি ডাকাত দল সড়কের ওপর গাছ ফেলে পরিবহনের গতিরোধ করে ডাকাতি শুরু করে। এসময় বাধা দিলে চালকের সহকারী রহিদুল ইসলাম ও চালক মোস্তাফিজুর রহমানকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে।  এসময় যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার ও মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে যায়।

এসময় সড়কে যাতায়াত করা অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, আলগামন, নছিমনসহ বেশ কয়েকটি গাড়ির গতিরোধ করেন ডাকাত দলের সদস্যরা।

এছাড়া গত ৬ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাংনী উপজেলার করমদি—ভোমরদহ রাস্তার চোরপোতা ভিটাপাড়া এলাকায় ওষুধ কোম্পানির দুই বিক্রয় প্রতিনিধির ওপর (রিপ্রেজেন্টেটিভ) বোমা হামলা ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নগদ ২০ হাজার টাকা ও একটি মোটরসাইকেল ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির (ভেটেরিনারি) প্রমোশন অফিসার মাজেদুল ইসলাম (৩৫) ও ইথিক্যাল ড্রাগস কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি মিরাজ আলী (৩৮) গুরুতর আহত হয়েছেন।

আহত জানান, তারা সীমান্তবর্তী তেঁতুলবাড়িয়া, করমদি, পলাশীপাড়া এলাকা থেকে ওষুধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে মোটরসাইকেলযোগে গাংনী ফিরছিলেন। তেঁতুলবাড়িয়া থেকে ভোমরদহ রাস্তা দিয়ে চোরপোতা এলাকায় পৌঁছালে ৬/৭ জনের একদল সশস্ত্র ছিনতাইকারী তাদের পথরোধ করে। মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নিতে চায়। চাবি দিতে না চাওয়ায় প্রথমে হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ মারে। পরে হাতে একটি বোমা মারে। বোমা ও অস্ত্রের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পকেটে থাকা ২০ হাজার টাকা ও একটি মোটরসাইকেল ছিনতাই করে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে গাংনী—হাটবোয়ালিয়া সড়কের বাথানপাড়া—রাইপুর মাঠের মধ্যে ১৮/২০টি মোটরসাইকেল ও একটি অটোভ্যান থামিয়ে গণ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এঘটনায় নগদ এক লাখ টাকাসহ ১৫/১৬টি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

তথ্য মতে, গত সেপ্টেম্বর মাসের বোমা হামলা, চুরি ও ছিনতাইয়ের আটটি ঘটনা ঘটে। গত ৬ সেপ্টেম্বর গাংনী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে থেকে কাজীপুর গ্রামের মাসুদ রানার একটি পালসার মোটরসাইকেল চুরি হয় যার নম্বর মেহেরপুর ল—১১—৪৬১২।

৯ সেপ্টেম্বর চিৎলা মাঠের মধ্যে থেকে এক পথচারীর কাছ থেকে একটি মোটরসাইকেল ছিনতাই হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর হাড়াভাঙ্গা গ্রামে আজাদের বাড়ি থেকে একটি গরু চুরির ঘটনা ঘটে। এসময় জনতার হাতে একজন চোর আটক হয়। একই রাতে মটমুড়া গ্রামে দোকান ভেঙে দোকানের মালামাল চুরির ঘটনা ঘটে। ২০ সেপ্টেম্বর বাওট বাজার থেকে চুরি হয় একটি অ্যাপাচি আরটিয়ার মোটরসাইকেল। যার নম্বর কুষ্টিয়া ল ১২—৫০০১।

স্থানীয়রা জানান, আগে এলাকায় পুলিশি টহল থাকার কারণে চুরি ডাকাতি ও ছিনতাই ছিল না। গভীর রাতেও মানুষ রাস্তাঘাটে চলাচল করতো। এখন সন্ধ্যার আগেই রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ে। রাস্তায় বের হলেও পড়তে হচ্ছে ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের কবলে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও মানুষ যেতে পারছেন না।

এ নিয়ে গত এক মাসে গাংনী উপজেলার পৃথক চারটি স্থানে হাতবোমা, কাফনের কাপড় ও চিরকুট রেখে গেছে দুর্বৃত্তরা। চুরি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ডর্জন খানেক। একের পর এক বোমা, কাফনের কাপড় ও হুমকির সংবলিত চিরকুট উদ্ধারের ঘটনায় জনমতে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান স্থানীয়রা।

গাংনী উপজেলার বেশ কয়েকটি পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ ফাড়ির পুলিশ একরকম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে দুষ্কৃতিকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বনী ইসরাইল জানান, গাংনীর বিভিন্ন এলাকায় এখন পুলিশের দৃশ্যমান উপস্থিতি আছে। আমরা এখন জনগণের সেবায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছি। বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত ও আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযানও শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে মেহেরপুর অ্যাডিশনাল এসপি সার্কেল আব্দুল করিম বলেন, গত ৫ আগস্টের পর কিছুদিন পুলিশের তৎপরতা কম থাকলেও এখন পুলিশি টহল এবং কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। চুরি ডাকাতির কোনো ঘটনায় আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে, বোমা, কাফনের কাপড় বা অন্যান্য ঘটনাগুলোতে পুলিশের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চলছে।  

গাংনীর বিভিন্ন এলাকায় অপরাধীদের আটকের জন্য অভিযান চালছে। আতঙ্কিত না হয়ে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।