নাটোরের সিংড়ায় গাইবান্ধার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ছাবিউল ইসলামের প্রাইভেটকার থেকে জব্দকৃত ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
রোববার (১৬ মার্চ) বিকেলে জেলার সিংড়া আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহান এ আদেশ দেন।
এদিন দুপুরের দিকে ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্তকারী কর্মকর্তা সিংড়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাজু আহমেদ জব্দ করা ওই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই আদেশ দেন।
অপরদিকে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করতে রোববার সকালে নাটোর আদালতে এসেছিলেন এলজিইডির ওই কর্মকর্তা। এসময় তাকে বৈধ কাগজপত্রসহ আদালতে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে টাকাগুলো তিনি জমি বিক্রির টাকা বলে দাবি করলেও এর সমর্থনে কোনো কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি।
সিংড়া আমলি আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) মো. নুরে আলম বাংলানিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অপরদিকে সিংড়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাজু আহমেদ জানান, সোমবার (১৭ মার্চ) জব্দ করা টাকা আদালতের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেবেন। টাকার উৎস সর্ম্পকে খোঁজখবর ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজশাহী অফিসে আবেদন করা হয়েছে। তারা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবেন।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) রাত ২টার দিকে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের চলনবিল গেট এলাকায় পুলিশের নিয়মিত চেকপোস্টে তল্লাশির সময় একটি প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে গাইবান্ধার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী পরিচয়দানকারী মো. সাবিউল ইসলামের কাছ থেকে ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা জব্দ করে পুলিশ। একই সঙ্গে গাড়িটি জব্দ করে ওই প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা হেফাজতে নেওয়া হয়।
গত ১৪ মার্চ সন্ধ্যার দিকে এ ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা তলব করা মাত্র হাজির হবেন -এমন শর্তে মুচলেকা দিয়ে সিংড়া থানা থেকে ছাড়া পান এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম। এ সময় তিনি ওই টাকা তার জমি বিক্রির টাকা বলে দাবি করেন। তবে এর সমর্থনে ছাবিউল কোনো প্রমাণ দিতে না পারায় পুলিশ ওই টাকা ও টাকা বহনকারী গাড়িটি জব্দ করে থানা হেফাজতে রাখেন।
সিংড়া আমলি আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) নুরে আলম বলেন, সিংড়া থানা হেফাজতে থাকা ওই টাকাগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা আজ রোববার দুপুরের দিকে আদালতে আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। ওই তদন্তকারী কর্মকর্তা সোমবার (১৭ মার্চ) জব্দ করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করবেন।
তিনি আরও বলেন, ১৬ মার্চ সকালে গাইবান্ধার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম তার কাছে এসেছিলেন জব্দ করা টাকা ফেরত নেওয়ার উপায় জানতে। তাকে বৈধ কাগজপত্রসহ আদালতে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে এলজিইডির কর্মকর্তা টাকাগুলো জমি বিক্রির টাকা বলে দাবি করলেও এর সমর্থনে কোনো কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি। তাই টাকার বৈধতা নিরূপণের জন্য তিনি দুদকে আবেদন পাঠিয়েছেন। তারা তদন্ত করে টাকার উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর এলজিইডির কর্মকর্তা ছাবিউলের ভাষ্য, জমি বিক্রি করা টাকা তিনি কর্মস্থল গাইবান্ধা থেকে রাজশাহীতে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ছাবিউল ইসলাম রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি বর্তমানে গাইবান্ধায় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তার আদি বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায় বলে জানা গেছে। তিনি গত ১৬ বছর ধরে ঘুরে ফিরে গাইবান্ধা জেলায় চাকরি করছেন। ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর মাসে উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় যোগ দেন তিনি। সেখানে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১৪ বছর ১ মাস ২২ দিন কর্মরত ছিলেন।
এরপর জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধা জেলা এলজিইডি কার্যালয়ে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর ছয় মাস ২৮ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সাবিউল ইসলাম নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে গত ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বরিশাল জেলায় যোগ দেন। সেখানে মাত্র ২৩ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তদবির করে গত একই বছরের ৬ অক্টোবর গাইবান্ধায় বদলি নেন তিনি।
পরদিন ৭ অক্টোবর তিনি গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। ৮ নভেম্বর তিনি পূর্ববর্তী নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে দায়িত্বও বুঝে নেন। সাঘাটায় যোগ দেওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে (১৬ বছর ৩ মাস ১২ দিন) তিনি গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত আছেন। চাকরিবিধি উপেক্ষা করে টানা প্রায় ১৬ বছর ধরে এক জেলাতেই ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
গত ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী সাবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা দায়ের করেছিলেন রাশেদ খান মেনন নামে এক ঠিকাদার। অবশ্য এ মামলায় আরও দুজনকে আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই মামলার আর অগ্রগতি হয়নি বলে ওই সূত্রটি দাবি করে। কারণ তিনি সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়ার খুব আস্থাভাজন ছিলেন। তাই বার বার এলজিইডির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করে দীর্ঘদিন তাকে সাঘাটায় রেখেছিলেন। এখনও বহাল তবিয়তে গাইবান্ধা জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে অনেক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে তিনি একটানা ১৪ বছর ১ মাস ২২ দিন সাঘাটা উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি পার্শ্ববর্তী ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবেও মাঝে মাঝে অতিরিক্ত (ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলীর বদলিজনিত কারণে) দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্বকালীন সময় ফুলছড়ি উপজেলার অসংখ্য জরাজীর্ণ সেতু ও কালভার্ট নিলামে বিক্রয় হয়। তিনি বিক্রয়কৃত প্রায় পৌনে ৩ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না করে অফিস সহায়ক মিলন হোসেনের সঙ্গে যোগসাজশে আত্মসাৎ করেন।
গাইবান্ধা জেলার এলজিইডির নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে এসব তথ্য জানান।
পরে এ ব্যাপারে মতামত নিতে ওই নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আর এ প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
** গাড়িতে তল্লাশি, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে পাওয়া গেল ৩৭ লাখ টাকা
** মুচলেকা দিয়ে জামিন পেলেন এলজিইডির সেই নির্বাহী প্রকৌশলী
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৫
এসআরএস