ঢাকা, শুক্রবার, ৭ চৈত্র ১৪৩১, ২১ মার্চ ২০২৫, ২০ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

হিটু শেখের ফাঁসি চায় ভুক্তভোগীর পরিবার

সুব্রত চন্দ ও জয়ন্ত জোয়াদ্দার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২৫
হিটু শেখের ফাঁসি চায় ভুক্তভোগীর পরিবার

মাগুরা থেকে: পাকা সড়ক লাগোয়া গাছপালায় ঘেরা দুটি দোচালা টিনের ঘর। পাশেই রান্নার ও গোয়াল ঘর।

মাঝে কয়েক ফুটের ছোট্ট একটি উঠান। মাগুরা শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামের এই বাড়িতেই থাকতো হিটু শেখের পাশবিকতার শিকার হয়ে মৃত্যুকে বরণ করা সেই শিশুটি।

বুধবার (১৯ মার্চ) বিকেল ৪টায় বাংলানিউজের টিম যায় ওই বাড়িতে। দোচালা বসত ঘর দুটির মাঝের ছোট জায়গা দিয়ে ঢোকার পর নিহত শিশুটির মাকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। সেখানে কয়েকজন সংবাদকর্মী উপস্থিত। তারা শিশুটির মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন।

সংবাদকর্মীরা তাকে প্রশ্ন করছেন, তিনিও উত্তর দিচ্ছেন। মেয়ের শোকে মা এতটাই পাথর হয়ে গেছেন, তার উত্তরগুলো প্রায় শোনা যাচ্ছে না। তবে জানা গেল, প্রতিদিন বিভিন্ন মানুষের আনাগোনা ও তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তারা এতটাই ক্লান্ত যে এখন শোকও প্রকাশ করার শক্তি পাচ্ছেন না।

নিহত শিশুটির মা আয়েশা আক্তার এখন নিষ্প্রাণ। বেশিরভাগ সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অন্যদিকে। ফ্যাল ফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকা সেই চোখে ভাসে তার ছোট্ট মেয়েটির ছবি। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে কিছুটা সময় নেন আয়েশা। তারপর মেয়েকে নির্যাতন ও হত্যার বিচার চান। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এহন আমি আর কি কবো? কডা দিন তো অনেক কথা কইসি। আর বলতি চাচ্ছিনে। আমি শুদু ওর (হিটু শেখ) ফাঁসি চাই জনগণের সামনে। আমার মনি বাঁইচে থাকতে এডা হওয়ার দরকার ছেলো। কিন্তু তাগের এহনো কিছুই হইনি।

ঘটনার আগে আপনার ছোট মেয়ে কখনো হিটু শেখের বাড়ি গিয়েছিল বা হিটু কি আপনাদের বাড়ি এসেছিল, প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, আমার মায়েডাও গ্যাছে, সেও (হিটু) এই বাড়ি এইসেছে। কিন্তু তায় যে এমন স্বভাবের তা তো জানতাম না। তার ভেতরে যে পশু ছেলো তা তো বুজদি পারিনি। সে তো পশুর চেয়েও খারাপ।

এ সময় কান্নার সুরে আয়েশা বলেন, এই যে ঘটনা ঘইটে গেল, আমি যে অসুস্থ সেইডে কেউ খেলা করতিসে না। আমি কীভাবে বাঁইচে আসি তা কেউ জানে না। আমি তো কথা কবার পারতিসি। কিন্তু যে করুণ দৃশ্য দেহিসি, আর কত সহ্য করবো?

স্বামীর বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর বাবার বাড়িতেই অবস্থান করছেন নিহতের বড় বোন হামিদা। শ্বশুর বাড়ির পাশবিকতায় ছোট বোনকে হারিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ প্রায়। হামিদা মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরিবারের লোকজন জানিয়েছে, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন হামিদা। বোন হারানোর বেদনা তাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। তিনি কারও সঙ্গেই কথা বলছেন না।

রোকসানা বেগম নামের তার এক খালা বলেন, হামিদা তো কতা কতি চাচ্চে না। কারও সাথেই কোনো কথা কচ্ছে না, চুপচাপ বইসে থাকে। নাওয়া খাওয়া ভুইলে গেছে। ধরে নিয়ে গোসল করাতি হয়। খাতি কইলেও খায় না। মায়ের সাথেও তেমন কথা কতি চায় না। পুরো সংসারটাই শ্যাষ। আমার বুনডাও (আয়েশা আক্তার) শ্যাষ হয়ে গেছে। সেও তো কথা বলতি পারে না। অসুস্থ হয়ে গেছে।

আছিয়ার বাবা ফেরদৌস শেখ আগে থেকেই মানসিক রোগে আক্রান্ত। মেয়ের মৃত্যুর পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হতভম্ব ফেরদৌস উৎসুক মানুষ বাড়িতে এলেই অপলক তাকিয়ে থাকেন। তার অসুস্থতা এতটাই বেড়েছে, মাঝে মাঝে তাকে মাঠে দৌড়ে বেড়াতে দেখা যায়। তাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। গত ১৮ মার্চ তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে গেছেন মামাতো ভাই সাদ্দাম। তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

এ বিষয়ে হামিদার আরেক খালা আনোয়ারা বলেন, আগে থেকেই দুলোভাইর মাথায় সমস্যা ছিল। মায়েডারে হারিয়ে পুরোপুরি মাথা খারাপ হয়ে গ্যাছে। ওইদিন দেখলাম, মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমরা এই ঘটনার বিচার চাই। আমাদের তো সব শ্যাষ। আগের মনিডারে তিলে তিলে মারলো। আমার মনিডা কতা পর্যন্ত কইয়ে যেতে পারলো না। আমরাও ওর (হিটু শেখ) জীবন চাই। আমার বোনডা (আয়েশা) জীবনে কত কষ্ট করিছে। এখন মেয়ে হারানোর কষ্ট কি সহ্য করতি পারে।

হামিদার সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আনোয়ারা জানান, তিনি বেশি কথা বলেন না। শুধু বোনের সঙ্গে পাশবিকতা ও হত্যার প্রতিশোধ চান।

ধলাই বেগম নামে নিহতের আরেক খালার দাবি, তার ভাগনির মৃত্যুর আগেই হিটু শেখের ফাঁসি হওয়ার দরকার ছিল। হামিদার শাশুড়ি আর ভাসুরের যে সাজাই হোক, তার স্বামী ও শ্বশুরের ফাঁসি চান তিনি।

নিহতের এক সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সে (নির্যাতনের শিকার শিশু) তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ছাত্রী হিসেবেও ভালো ছিল। মিশুক স্বভাবের মেয়েটি সবার সঙ্গে ভালোভাবে কথাবার্তা বলত। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় তারা সব সহপাঠী হতভম্ব। এমন ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে তারা।

ধর্ষণ ও হত্যার শিকার শিশুটিকে দাফন করা হয়েছে তার নিজ বাড়ি থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে সোনাইকুন্ডী গ্রামের জামিয়া উমর বিন খাত্তাব (রা.) গোরস্তানে। সন্ধ্যার নিভু নিভু আলোয় সেখানে গিয়ে দেখা যায় একটি কবরে কাগজের ওপর নিহতের নাম লেখা।

উল্লেখ্য, গত ৫ মার্চ মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় ৮ বছরের একটি শিশু। পরদিন ৬ মার্চ তাকে অচেতন অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় একটি মাদরাসার ইমামের কাছে নিয়ে যান হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম। পরে তাকে সেখান থেকে মাগুরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখান তার অবস্থার অবনতি ঘটলে ওইদিনই প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ও পরে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৩ মার্চ মারা যায় পাশবিক নির্যাতনের শিকার শিশুটি। সেদিনই তার মরদেহ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে মাগুরা এনে নিজ গ্রামে দাফন করা হয়।

এই ঘটনায় ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন শিশুটির মা আয়েশা আক্তার। মামলায় আসামি করা হয় শিশুটির বোনের স্বামী সজীব শেখ, ভাসুর রাতুল শেখ, শ্বশুর হিটু শেখ ও শাশুড়ি জাহেদা বেগমকে। বর্তমানে তারা সবাই রিমান্ড শেষে জেলা কারাগারে আছেন। এর মধ্যে মামলার প্রধান আসামি হিটু শেখ মাগুরা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২৫
এসসি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।