হবিগঞ্জ: একাত্তরের ৪ এপ্রিল যুদ্ধক্ষেত্রকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করাসহ মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া ম্যানেজার বাংলোর গোপন বৈঠক থেকে। এখান থেকে শপথ এবং এখান থেকেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া।
সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের একটি ভাস্কর্যও রয়েছে মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে। যেটি তেলিয়াপাড়ার বাংলোতেই স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু কী কারণে তা হয়নি বিষয়টি অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।
৪ এপ্রিলকে স্থানীয়ভাবে ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও স্থানটি জাদুঘরে রূপান্তরিত না হওয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং এলাকাবাসী অখুশি।
মুক্তিবাহিনী গঠন, মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ও রাজনৈতিক সরকার গঠনের প্রস্তাব তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রথম পাঠের অনুশীলন হয়েছিল তেলিয়াপাড়া ম্যানেজার বাংলো থেকে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ইতিহাসের অমূল্য উপাদান সেখানে বিদ্যমান। সমরক্ষেত্র হিসেবেও এ স্থানের রয়েছে অতুলনীয় গৌরবগাঁথা।
অথচ ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া ম্যানেজার বাংলোকে বাঙালি জাতির স্মরণে রাখতে তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধরে রাখার স্বার্থে এ বাংলোটিকে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রূপান্তরিত করার দাবি জানিয়ে আসছেন হবিগঞ্জবাসী।
একাত্তর সালের ৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন ২৭ সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এক গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ এবং রণাঙ্গণকে ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেডে ভাগ করা হয়েছিল।
সেদিন ম্যানেজার বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী পিস্তলের গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের শুভ সূচনা করেন। তেলিয়াপাড়াকেই প্রথম অস্থায়ী সেনা সদর দপ্তর গণ্য করা হয় এবং মুক্তিবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারণী তিনটি সভার দু’টি হয়েছে এখানে।
বৈঠকে তৎকালীন কর্নেল এমএজি ওসমানী, লেফট্যানেন্ট কর্নেল এমএ রব, লেফট্যানেন্ট কর্নেল সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর কেএম শফিউল্লাহ্, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নূরুজ্জামান, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর আবু ওসমান, মেজর সিআর দত্ত, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিন, ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভিসি পাণ্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
তিন নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কেএম শফিউল্লাহ তার হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অনেক। এখান থেকে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। তবে ২১ জুনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার তুলে নেওয়া হয়।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ছিল তেলিয়াপাড়া। তবে আজও এ স্থানটি অবহেলিত। আমাদের প্রত্যাশা স্বাধীনতার পক্ষের সরকার ঐতিহাসিক এই স্থানটিকে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার ব্যবস্থা করবেন। আমরা প্রতি বছর ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া দিবস পালন করে থাকি। সেখানে জীবিত সব সেক্টর কমান্ডারসহ বিপুল সংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশ ঘটে।
হবিগঞ্জের মাধবপুরে তেলিয়াপাড়া ম্যানেজার বাংলোতে বুলেটের আকৃতিতে তৈরি একটি স্মৃতিসৌধের প্রবেশ পথে রয়েছে দুটি ফলক। তাতে অঙ্কিত রয়েছে কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতার পঙতিমালা। দক্ষিণ দিকে লাগানো ফলকটি জানান দেয়, এ স্থানটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত। সেখানে স্মৃতিফলকে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনা ও সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা ৩৩ জনের নামের তালিকা।
চা-বাগানের সবুজের বেষ্টনীতে স্মৃতিসৌধ ছাড়াও আছে একটি প্রাকৃতিক জলাশয়। লাল শাপলা ফোটা এই জলাশয় বর্ষাকালে অপরূপ হয়ে ওঠে। স্মৃতিসৌধ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই ঐতিহাসিক সেই বাংলো।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০২১
আরএ