ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাজেটে যোগাযোগ খাতের বরাদ্দে গোঁজামিল, নৌ-রেলখাতও পিছিয়ে

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২৩
বাজেটে যোগাযোগ খাতের বরাদ্দে গোঁজামিল, নৌ-রেলখাতও পিছিয়ে

ঢাকা: জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান যোগাযোগ (যাত্রী পরিবহন) এবং নৌ ও আকাশপথে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে পণ্য পরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থবরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে ৮৭ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা।

গত বৃহস্পতিবার (১ জুন) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে দেওয়া লিখিত বাজেট বক্তৃতায় এ বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। যা এ খাতে বর্তমান বরাদ্দের চেয়ে ৬ হাজার ১১০ কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ৮১ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। তবে প্রস্তাবিত বরাদ্দে সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান- এ চারটি যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের জন্য আলাদাভাবে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি।

নদ-নদী রক্ষা ও নৌ যোগাযোগ খাতের আধুনিকায়নসহ গণ-পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আলাদা আলাদা বরাদ্দ না থাকায় অতীতের মতো এবারো বরাদ্দের সিংহভাগ সড়ক ও মেট্রোরেল অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য ব্যয় হবে। এর বিপরীতে উপেক্ষিত হবে ব্যয়-সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ ও জনবান্ধব নৌ-খাত। এছাড়া অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও তুলনামূলক উপেক্ষিত হবে বলে মনে করছেন তারা।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়- সড়ক, সেতু, রেল, নৌ ও আকাশপথের সমন্বিত উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মূল উদ্দেশ্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরাপদ, টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে চলমান কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ন ও পরবর্তীতে এগুলোর মান সংরক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বাজেট বক্তৃতায় ২০০৯ সাল থেকে সড়ক, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণের ফলে সারা দেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার (কি.মি.) দৈর্ঘ্যের মহাসড়ক তৈরি করে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন নির্বিঘ্ন ও নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রায় ৭১৮ কি.মি. জাতীয় মহাসড়ক চার বা তারও বেশি লেনে উন্নীতকরণ, বিভিন্ন মহাসড়কে ১ হাজার ৫৫৮টি সেতু ও ৭ হাজার ৪৯৮টি কালভার্ট নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ এবং সড়ক নেটওয়ার্কে ১৫টি রেলওয়ে ওভারপাস ও ১৮টি ফ্লাইওভার যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

যাত্রাবাড়ী ইন্টারসেকশন হতে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এক্সপ্রেসওয়ের যুগে প্রবেশ করেছে। সামনের দিনগুলোয় সারা দেশে ২ হাজার ৩৪২ কি.মি. জাতীয় মহাসড়কের উভয় পাশে সার্ভিস লেনসহ ৪ লেনে উন্নীতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়।

এছাড়া অর্থমন্ত্রী জানান, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সড়ক-টানেল নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্রুত যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালি পর্যন্ত র‌্যাম্পসহ ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ জুন ২০২৪ সময়ের মধ্যে সম্পন্ন এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর হতে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে। এর পাশাপাশি গাজীপুর হতে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেন নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে এবং কিছু অংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, ঢাকা মহানগরী ও আশপাশের এলাকার যানজট নিরসন ও দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত করতে ছয়টি মেট্রোরেল লাইনের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ গত ডিসেম্বরে চালু হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে মেট্রোরেল কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার পাতাল ও নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার উড়ালসহ মোট ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২১টি স্টেশনবিশিষ্ট মেট্রোরেলের আরেকটি লাইন নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী-আফতাবনগর-দাশেরকান্দি রুটে ১৭ দশমিক ২০ কি.মি. দীর্ঘ মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। গাবতলী-কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ এবং গোলাপশাহ মাজার-সদরঘাট রুটে উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে মোট ৩৫ কি.মি. দীর্ঘ মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ করা হবে। মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের এ বিস্তৃতি যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে গণ-পরিবহণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে।

রেলখাতের উন্নয়নের বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, ২০০৯ সালের পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৩৯ দশমিক ৭১ কি.মি. নতুন রেললাইন নির্মাণ, ২৮০ দশমিক ২৮ কি.মি. মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, ৭৩২টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ এবং ১৪৪টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। বর্তমানে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের কাছে গুনদুম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ ইত্যাদি।

বাজেট বক্তৃতায় নৌ-খাত সম্পর্কে বলা হয়, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশ সমুদ্রবন্দরগুলোর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে স্থল ও নদীবন্দরসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রপ্তানি বাণিজ্য এবং দেশি-বিদেশি বাণিজ্য সম্প্রসারণে অন্যতম লজিস্টিকস হলো সমুদ্র ও নদীবন্দরসমূহ। এজন্য সমুদ্র, নদী ও স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ সাধনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

নৌ-পথে যাত্রী পরিবহন সম্পর্কে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের লক্ষ্যে ঢাকার চারপাশে ১১০ কি.মি. বৃত্তাকার নৌ-পথ নির্মাণ করা হয়েছে, বর্তমানে এর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। গত ১৪ বছরে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীতে খনন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার ৭২০ কি.মি. নৌ-পথ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট পরিবেশবিদ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে মোট ব্যয়বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। এতে বোঝার উপায় নেই যে, কোন খাতে কত বরাদ্দ হচ্ছে। তবে সড়ক ও মেট্রোরেল অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনার যে ফিরিস্তি তিনি তুলে ধরেছেন, তাতে ধারণা করা যায় যে, অতীতের মতো এবারো নৌ ও রেল যোগাযোগ তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত হবে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ নৌ-খাতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের উন্নয়ন সম্পর্কে বাজেট বক্তৃতায় কিছু বলা হয়নি।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ শহীদ মিয়া বলেন, অর্থমন্ত্রী যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ঢাকার চারপাশে ১১০ কি.মি. বৃত্তাকার নৌ-পথ নির্মাণ ও গত ১৪ বছরে প্রায় ৩ হাজার ৭২০ কি.মি. নৌ-পথ পুনরুদ্ধারের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার নৌ-পথ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত সুবিধা বৃদ্ধি করবে না। এছাড়া ১৪ বছরে প্রায় ৩ হাজার ৭২০ কি.মি. নৌ-পথ পুনরুদ্ধার হলেও তা শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। অথচ সড়ক ও মেট্রোরেল খাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২৩
টিএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।