ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পেঁয়াজ সংরক্ষণে ৬৫ মডেল ঘর নির্মাণ, ফরিদপুরে কৃষকের মুখে হাসি

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩২ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০২৪
পেঁয়াজ সংরক্ষণে ৬৫ মডেল ঘর নির্মাণ, ফরিদপুরে কৃষকের মুখে হাসি

ফরিদপুর: পেঁয়াজ উৎপাদনের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফরিদপুর জেলা। আর এই জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে সালথা ও নগরকান্দা উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে।

মসলা জাতীয় এই ফসলটির ফলন ও দাম ভাল হওয়ায় প্রতিবছরই এখানে বাড়ছে পেঁয়াজের আবাদ। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এখানকার উৎপাদিত পচনশীল ফসল পেঁয়াজের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়।

এমন অবস্থায় বিগত কয়েক বছর ধরে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল উভয় উপজেলার প্রান্তিক কৃষকরা। অবশেষে তাদের সেই দাবি পূরণ হতে শুরু করেছে। পেঁয়াজ সংরক্ষণে সালথা-নগরকান্দায় ৬৫টি মডেল ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।  

ইতিমধ্যে এসব ঘরে পেঁয়াজ মজুত রেখে কৃষকদের মুখে হাঁসি ফুটতে শুরু করেছে। কৃষকদের দাবি, পেঁয়াজ চাষিদের তালিকা করে এমন ঘর প্রত্যেকটি গ্রামে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্মাণ করা হলে তারা অনেক উপকৃত হবেন।

পেঁয়াজের সংরক্ষণের জন্য সালথা উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের ঝুনাখালী ও আড়ুয়াকান্দী এলাকায় তিনটি মডেল ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঝুনাখালি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক মো. আমজেদ মাতুব্বরের বাড়ির উঠানে এক শতক জমির ওপর চার লাখ টাকা ব্যয়ে টিনের চাল ও বাঁশের বেড়া দিয়ে একটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ১৫টি পাকা খাম্বার ওপর ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থ ঘরটি তৈরি করা হয়েছে।

মাটি থেকে তিন ফুট পরপর তিনটি বাঁশের মাচা বানানো হয়েছে। ওই মাচার ওপরে পেঁয়াজ ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। ঘরের নিচে আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ঘরের গরম বাতাস বের করার জন্য পেছনে দেওয়া হয়েছে ছয়টি ফ্যান। ঝড়-বৃষ্টি থেকে পেঁয়াজ রক্ষা করতে চারপাশে রাখা হয়েছে ত্রিপল। ওই ঘরে ৩০০ মণ করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে। সেখানে ছয় থেকে নয় মাস পেঁয়াজ ভালো থাকবে।

কৃষক আমজেদ বলেন, গত বছর আমার বাড়ির ঘরটি নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ১৪০ মণ পেঁয়াজ রেখেছিলাম। যা শুকিয়ে ১৩৫ মণ পেঁয়াজ ভাল ছিল। এবারও এই ঘরে পেঁয়াজ রেখেছি। আমার পাশাপাশি প্রতিবেশী সোহেল হোসেন ৫০ মণ ও শিউলি বেগম ৫০ মণ পেঁয়াজ রেখেছে।

পার্শ্ববর্তী আড়ুয়াকান্দী গ্রামের কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবছর ৪০০ থেকে ৫০০ মণ পেঁয়াজ পাই। পেঁয়াজ পচনশীল হওয়ায় আমাদের পক্ষে সংরক্ষণ করা দুরূহ হয়ে উঠতো। যে কারণে পেঁয়াজ মৌসুমে অল্প দামে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে হতো। তবে মডেল ঘর পাওয়ার পর কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়েছি। যদিও এবারই প্রথম আমি ও আমার ভাই ওই ঘরে পেঁয়াজ রাখা শুরু করেছি। আমরা দুই ভাই মিলে ৩০০ মণ পেঁয়াজ রেখেছি। এখন পর্যন্ত পেঁয়াজগুলি ভালো আছে।

পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর দেখতে আসা সালথার সিংহপ্রতাপ গ্রামের কৃষক সোহেল মাহমুদ বলেন, ঘরটি দেখতে অনেক সুন্দর। নিজ উদ্যোগে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা নিয়ে সারা বছর চিন্তা থাকতে হয়। নিজেরা অনেক যত্ন করে রাখি। তারপরেও দেখা যায় ৪-৫ মাস পর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এই মডেল ঘর দেখতে এসেছি। আগামী বছর আমি নিজেই এই আদলে ঘর নির্মাণ করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করবো। তবে পেঁয়াজ চাষিদের তালিকা করে এমন ঘর প্রত্যেকটি গ্রামে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্মাণ করা হলে কৃষকরা অনেক উপকৃত হবে।    

কৃষিবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফরিদপুর জেলায় ৩৫ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল চার লাখ ৪৫ হাজার ৯৮২ মেট্রিক টন। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পেঁয়াজের আবাদ পাঁচ হাজার হেক্টর বেড়ে ৪০ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ ৫২ হাজার ৭৩৬ মেট্রিক টন।

ফরিদপুর সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. সাহাদাত হোসেন বলেন, আমাদের দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের মধ্যে শেষ পর্যন্ত প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টন টিকে থাকে। চাহিদার থেকে বেশি উৎপাদন হওয়ার পরও দেশে প্রতিবছর ছয় থেকে সাত লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় পেঁয়াজ-রসুন রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।

এরই ধারবাহিকতায় গত বছর থেকে সালথা ও নগরকান্দা উপজেলায় ৬৫টি পেঁয়াজ সংরক্ষণের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সালথায় ৩০টি ও নগরকান্দায় ৩৫টি। প্রতিটি ঘরে ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ৬২টি ঘরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাকি তিনটি ঘর নির্মাণ কাজ দেরিতে শেষ হওয়ায়, সেগুলোতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এসব ঘরে মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবে কৃষকরা। দুই তিন বছর পর পর মেরামত করা হলে ঘরটি ২০ থেকে ২৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। একটি ঘরে ৩০০ মণ পেঁয়াজ রাখা যাবে। পাঁচজন কৃষকের জন্য একটি ঘর করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের তৈরি ঘর দেখে চাষিরা যদি তাদের নিজ উদ্যোগে এই মডেল ঘর নির্মাণ করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে। তাহলে তাদের পেঁয়াজ আর নষ্ট হবে না। আমরা সার্বক্ষণিক কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। তারা যে-সব সমস্যার কথা তুলে ধরবেন আমরা তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩২ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।