ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ফেনীতে চারিদিকে বানের ক্ষত, কৃষিখাতে ক্ষতি ৯০০ কোটি টাকা

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২৪
ফেনীতে চারিদিকে বানের ক্ষত, কৃষিখাতে ক্ষতি ৯০০ কোটি টাকা স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ফেনীর জনপদ

ফেনী: স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ফেনীর জনপদ। বন্যার পানি নেমে জেলার নিম্নাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।

 তবে এরইসঙ্গে বন্যার ক্ষতচিহ্নও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।  

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর দেখা গেছে, ক্ষেতে মাচান থাকলেও নেই সবুজ গাছ। পানির নিচ থেকে ভেসে উঠছে হলুদ, আদা, আউশ, আমন ও শরৎকালীন বিভিন্ন সবজিক্ষেত। সব নষ্ট হয়ে গেছে।  

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে ঘটে যাওয়া ফ্ল্যাস ফ্লাডে বন্যাকবলিত ছয় উপজেলায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯১৪ কোটি টাকা। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলায় শুধু ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

জানা গেছে, বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তারমধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, আবাদকৃত ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরো অংশ, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পরশুরামের কাউতলি গ্রামের কৃষক আলী আহম্মদ বলেন, বছরের প্রথম দফায় বন্যায় আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপর আবার বীজ বপন করে আমন আবাদের কিছুদিন পর বন্যার পানিতে সব ভেসে যায়। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফার বন্যায় সব ফসলি জমিতে এখন বালুর স্তূপ পড়ে আছে। কোনোভাবে আবাদ করে খাব এমন পরিস্থিতি আর নেই।

সাইদুল ইসলাম নামে আরেক কৃষক বলেন, ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছি আমরা। জমির ফসল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ঘরে থাকা ধান-চালও পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে আবাদ করার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।  

এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন জানান, বন্যায় কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। আমাদের জেলা কার্যালয়ও বুক পানিতে নিমজ্জিত ছিল। তারপরেও আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং তাদের নানা পরামর্শের মাধ্যমে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কৃষকদের আমনের চারা প্রদান করার ব্যাপারে দাপ্তরিকভাবে একটি কথা উঠে এসেছে। এছাড়া এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আগাম জাতের কিছু ফসল আবাদের বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত জুলাই মাসের বন্যায় ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ায় আউশ আবাদ, গ্রীষ্মকালীন সবজি, আমন বীজতলা ও গ্রীষ্মকালীন মরিচের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে তিন উপজেলার বেশিরভাগ ফসলি জমি। তখন কৃষিতে সবমিলিয়ে ১ কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এতে ১ হাজার ৭১৯ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে ফেনীর জনপদের মানুষজন। টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া মানুষদের আর্তি ছিল প্রাণে বাঁচার। দুর্যোগে অনেকে গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগি নিয়ে আবার কেউ ফেলে রেখেই নিরাপদে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে শত শত একর চারণভূমি। পানিতে তলিয়ে বিনষ্ট হয়েছে পশুপাখির দানাদার খাদ্য-ঘাস, খড়। এ অবস্থায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন কৃষক ও খামারিরা।

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, এবারের বন্যায় প্রাণিসম্পদ খাতে এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ছিল ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। জেলার ছয় উপজেলায় ৩৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৩৮ হাজার ৭৩১টি গরু, ৩৫৯টি মহিষ, ১৫ হাজার ৫৮৮টি ছাগল ও ৭৩৬টি ভেড়া মারা গেছে। এছাড়াও ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৫১০টি মুরগি ও এক লাখ ৮৯ হাজার ৪৭২টি হাঁস মারা গেছে। মৃত পশুপাখির মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৮ কোটি ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩০ টাকা।

সূত্র জানায়, জেলায় ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৬৩টি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এক হাজার ৯৯২টি গবাদিপশুর খামারের ১৩ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা এবং এক হাজার ৬২৩টি হাঁস-মুরগির খামারের ১০ কোটি ৯৭ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও ৩ হাজার ৯৫০ টন পশুপাখির দানাদার খাবার বিনষ্ট হয়েছে যার বাজারমূল্য ২৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জেলায় ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার খড়, ৩ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকার পশুপাখির ঘাস বিনষ্ট হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ২৮৫ একর চারণভূমি।

ফুলগাজীর খামারি আলমগীর হোসেন বলেন, বন্যার ১৫ দিন আগে খামারে মুরগি নিয়েছিলাম। কোনো কিছুই সরাতে পারিনি। দেড় হাজার মুরগি, সঙ্গে খাবারসহ অন্যান্য সব জিনিসপত্র পানিতে ভেসে গেছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কোনোভাবেই সম্ভব না। এখন যদি স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে অনেকে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

কৃষক আবদুর রাজ্জাক বলেন, তিনটি গরু লালনপালন করে কোনোমতে অভাবের সংসার সামলে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ এ বন্যায় সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে একটি আশ্রয়কেন্দ্র গিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারলেও গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি বন্যার পানিতেই রেখে যেতে হয়েছে। পানি নামার পর বাড়ি ফিরে এগুলোর আর কিছুই পাইনি।

এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক জানান, বন্যায় জেলার প্রাণিসম্পদ খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। অনেক এলাকা এখনো পানিতে ডুবে থাকায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

খামারি ও কৃষকদের সহায়তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওষুধ ও খাদ্য। জেলায় গত কয়েকদিনে ৫০০ কেজি খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে সমন্বয় করে আমরা খামারি ও কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো চেষ্টা করছি। এছাড়া দাপ্তরিকভাবে কোনো ধরনের প্রণোদনা অথবা সহায়তা এলে তা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করব।  

ফেনীতে বন্যায় জেলার অধিকাংশ পুকুর ও ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। বন্যায় মৎস্যখাতে রেণু, পোনা, বড় মাছ ও পুকুরের অবকাঠামো মিলে ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গতকাল বুধবার (২৮ আগস্ট) জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।

জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে জেলার ছয়টি উপজেলায় বন্যায় মাছচাষিদের ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ সংশ্লিষ্ট অন্তত ২০ হাজার মানুষ। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে একক ও যৌথ মালিকানাধীন ১৮ হাজার ৭৬০টি পুকুর-দীঘি। এসব পুকুর থেকে ২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বড় মাছ এবং ৯৭ লাখ টাকার মাছের পোনা ভেসে গেছে। এছাড়া জেলায় খামারিদের ৫৪ লাখ টাকার অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

বীরচন্দ্রনগর এলাকার মৎস্য খামারি মো. দুলাল বলেন, নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের চারপাশে নেট জাল দিয়ে ঘিরে রেখেছিলাম। কিন্তু বাঁধ ভেঙে পানির তীব্র স্রোতে এটি কোনো কাজে আসেনি। সবকিছু পানিতে ভেসে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে কোনোভাবেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।

ফুলগাজীর ঘনিয়ামোড়া এলাকার মাছচাষি হাসিবুর রহমান বলেন, অন্যান্য বারের বন্যায় চেয়ে এবার পানির চাপ অনেক বেশি ছিল। মাত্র দেড়মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় বন্যার পানিতে সব ভেসে গেছে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই বারবার লোকসান গুনতে হচ্ছে। অনেকেই ব্যবসায় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যার পানিতে অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে। খামারিরা মাত্র দেড় মাসের মাথায় তৃতীয় দফার বন্যায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

তবে অন্যান্য দপ্তরের ন্যায় মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনার সুযোগ নেই বলে জানান এ কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত, এর আগে গত মাসের বন্যায় জেলার ফুলগাজী উপজেলায় ২৬৫টি পুকুর ভেসে সাড়ে ৪০ লাখ টাকার মাছ ও সাড়ে ৭ লাখ টাকার মাছের পোনা ভেসে যায়। উপজেলায় মাছচাষিদের ২০ লাখ টাকার আসবাবপত্র নষ্ট হয়। সবমিলিয়ে ফুলগাজীতে ৬৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছিল। একইভাবে পরশুরাম উপজেলায় ৮০টি পুকুর ভেসে ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার মাছ ও ৩০ লাখ ৭০ হাজার টাকার মাছের পোনা ভেসে যায়। উপজেলায় মাছচাষিদের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। সবমিলিয়ে পরশুরামের মৎস্য খাতে প্রায় সাড়ে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২৪
এসএইচডি/এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।